বাংলার কালো ছাগল পালন অত্যন্ত লাভজনক। মাঠে ছেড়ে পুষলে ছাগল তার খাবারের ৭০% জোগাড় করে নেয়। সঙ্গে অল্প দানা খাবার দিলেই যথেষ্ট। অল্প জায়গা লাগে এবং স্বল্প মূলধনে সহজেই পালন করা যায় । রোগব্যাধি কম হওয়ায় ঝুঁকিও কম। সুস্বাদু, পুষ্টিকর মাংসের জন্য চাহিদাও বেশি এই ছাগলের। ছাগলের চামড়া চর্মশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল ও মল-মূত্র উন্নত মানের জৈব সার। সব মিলিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে খাবার, পরিচর্যা, রোগ প্রতিরোধ ও প্রজনন করালে ছাগল পালনে (Black Goat Rearing) লাভ সুনিশ্চিত।
ভারতে ছাগলের প্রায় ২০ রকমের প্রজাতি আছে। এর মধ্যে কোনওটি মাংস উৎপাদক, কোনওটি দুধ দেওয়ার জন্য কাজে লাগে। পশ্চিমবঙ্গের কালো ছাগল প্রজনন ক্ষমতা, মাংস ও চামড়ার জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। এদের মাংস সর্বোৎকৃষ্ট। পৃথিবী বিখ্যাত মরক্কো চামড়া এই জাতের ছাগল থেকে পাওয়া যায়। সঠিক সময়ে প্রজননে এরা ২ বছরে গড়ে ৩ বার বাচ্চা দেয় এবং প্রতি বারে ২-৪টি শাবক প্রসব করে। এই কালো স্ত্রী ছাগল ১০ মাস ও পুরুষ ছাগল ১২ মাস বয়সে প্রজননযোগ্য হয়। সুস্থ প্রজননের জন্য ১০টি স্ত্রী ছাগল পিছু ১টি পুরুষ ছাগল রাখা প্রয়োজন।
ছাগল খামার (Goat farm):
ছাগল পালনের জন্য আহামরি কোনও বন্দোবস্তের প্রয়োজন না হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, শুকনো ও স্বাভাবিক আলো-বাতাসযুক্ত থাকার জায়গা খুবই প্রয়োজনীয়। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ছাগল পালন করতে চাইলে বয়স অনুযায়ী বাচ্চা ছাগল, স্ত্রী ছাগল, পাঁঠা, গর্ভবতী ছাগল, প্রসব ঘর, দুধের জন্য ঘর ও অসুস্থদের জন্য আলাদা করে ঘর খামারে তৈরি করতে হবে।
ছাগলের প্রয়োজনীয় টিকা (Goat’s Vaccination):
কালো ছাগল পালনে সঠিক লাভ করতে চাইলে এদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে হয় | যার প্রধান হলো সঠিক টিকাকরণ,
১) পি-পি-আর:
সব বয়সের ছাগলকে এই টিকা দিতে হবে | শুধুমাত্র গর্ভবতী ছাগলদের এই টিকার প্রয়োজন নেই | বছরে ১ বার চামড়ার তলায় ১ মিলি ইনজেকশন দিতে হবে |
২) ছাগ বসন্ত:
৩ মাস বয়সে প্রথমবার ও পরে বছরে ০.৫ মিলি করে ১ বার টিকা দিতে হবে | বসন্ত হলে ছোট দুর্বল বাচ্চা মারা যায় | বড়রা বেঁচে গেলেও গুটি-ঘা এর কারণে চামড়া নষ্ট হয়ে যায় |
৩) খুরাই রোগের টিকা:
৩ থেকে ৪ মাস বয়সে প্রথম টিকা, তারপর প্রতি ৬ মাস অন্তর বুস্টার টিকা দিতে হবে | পরবর্তীকালে ১ বছর অন্তর এই টিকা দিলে চলবে | তবে, যে এলাকায় খুরাই রোগের প্রাদুর্ভাব নেই সেখানে এই টিকা না দিলেও চলবে |
৪) কৃমিনাশক প্রয়োগ:
৭ দিন বয়সে প্রথম ওষুধ দিতে হবে। ৩ মাস পর্যন্ত পাইপারেজিন হেক্সাহাইড্রেট ১ মিলি প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতি মাসে ১ বার দিতে হবে। ৪ মাস বয়সে অ্যালবেন্ডাজল বা মেবেন্ডাজল ১০ মিলিগ্রাম প্রতি কেজি ওজনে প্রয়োগ করুন। ৫ মাস বয়সে অক্সিক্লোজেনাইড ১০ মিলি গ্রাম প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে। এরপর থেকে প্রতি ২ মাস অন্তর উপরোক্ত ক্রম অনুযায়ী ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে | প্রতিবার কৃমিনাশক ওষুধ প্রয়োগের পরে ভিটামিন ও খনিজ লবনের মিশ্রণ সহযোগে হালকা খাবার দিতে হবে। গুড় মিশ্রিত ফ্যান ভাত ভাল কাজ দিতে পারে।
ছাগলের খাদ্য (Goat’s food):
৩-৫ দিন বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের গাঁজলা দুধ খাওয়ানো প্রয়োজন। জন্মের পর প্রথম ২ সপ্তাহ বাচ্চা মায়ের দুধ খাবে এবং তারপর কচি ঘাস-পাতা ও দানা খাবার খাওয়াতে হবে। এভাবে ২ মাস পর্যন্ত চলবে। বাড়ন্ত ছাগলকে বেঁধে পালন করলে দৈনিক ২-৩ কেজি সবুজ ঘাস ও ৫০-১০০ গ্রাম দানাখাদ্য (ভুট্টার গুঁড়ো, খুদের চাল, ছোলার গুঁড়ো, বাদাম, সর্ষের খোল, গমের ভুসি, চালের কুঁড়ো, ভিটামিন, লবন ইত্যাদি) দিতে হবে। গর্ভবতী ছাগলকে শেষ ২ মাস প্রতি দিন ২০০ গ্রাম দানাখাবার এবং শেষ সপ্তাহে দানাখাদ্য কমিয়ে সবুজ ঘাস বাড়াতে হবে। পাঁঠাকে ছেড়ে পুষলে আলাদা করে সবুজ ঘাস খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। তবে প্রজননের সময় সঙ্গে দৈনিক ২০০ গ্রাম দানাজাতীয় সুষম খাদ্য দেওয়া প্রয়োজন। ইউরিয়া মিশ্রিত খড় খাওয়ানো যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর ঘাস যেমন বারসীম, লুসার্ন, জোয়ার, ভুট্টা, প্যারা, নেপিয়ার খাওয়ালে দানাখাদ্যের প্রয়োজন হয় না। দুগ্ধবতী ছাগলকে অবশ্য দানাখাদ্য দিতেই হবে।
আরও পড়ুন - Mola Fish Farming: পুকুরে মলা মাছ চাষ করতে চান? শিখে নিন দারুন পদ্ধতি
ছাগলের পরিচর্যা:
সপ্তাহে অন্তত ১ দিন ছাগলের খামার পরিষ্কার করে শুকনো করার পরে ২-৩% ফরমালিন দ্রবণ ২০-৩০ মিলি জলে মিশিয়ে স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে | বাচ্চা জন্মানোর পর নাক, মুখ ও শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে শ্লেষ্মা পরিষ্কার করতে হবে এবং নাভিরজ্জু ২ ইঞ্চি রেখে সুতো দিয়ে বেঁধে জীবাণুমুক্ত ব্লেড দিয়ে কাটতে হবে ও গোড়ায় টিংচার আয়োডিন লাগাতে হবে। জীবাণুনাশক দিয়ে মা ছাগলের বাঁট ও শরীরের অন্যান্য অংশ পরিষ্কার করতে হবে।
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - আয় বৃদ্ধির জন্য কোন জাতের গো - পালন করবেন কৃষকবন্ধুরা?