পাঙ্গাস মাছ স্বল্প নোনা জল এবং মিঠা জলের মাছ। প্রতিকূল পরিবেশ এই মাছ উৎপাদনক্ষম। তাই সহজে যেকোনো পুকুরে চাষ করা যায় এবং নতুন চাষিরাও এই মাছের চাষ শুরু করতে পারেন। পাঙ্গাস মাছের দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে, ফলে রুইজাতীয় মাছ চাষের চেয়ে পাঙ্গাস মাছের চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। সর্বভুক বলে খাদ্যের অপচয় কম, সম্পূরক খাদ্য দিয়ে অন্যান্য মাছের সাথেও চাষ করা যায়। স্বল্প সময়ে (৫-৬ মাসে) বাজারজাত করে মুনাফা অর্জন করা যায়। যদি এই মাছ বাজারে তাজা অবস্থায় বিক্রয় করা যায়, তবে বিক্রি ভালো হয়।
পুকুর তৈরি -
অন্য মাছ চাষের মতোই পাঙ্গাস মাছের পুকুর ভালো ভাবে আগাছা ও আমাছা মুক্ত করতে হবে।
বিঘা প্রতি ৩০ কেজি কলিচুন ভালো করে জলে গুলে পুকুরের জলে মিশিয়ে দিতে হবে।
পুকুরের জলের গভীরতা অন্তত ২ – ২.৫ মিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এই মাছ অধিক ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। জলাশয়ের নীচের তল এক দিকে বেশি ও অন্য দিকে কম গভীর হলে জলের উত্তাপের তারতম্য হয়। মাছেরা তাদের পছন্দ ও সহ্যসীমার উপর ভর করে আশ্রয় নিতে পারে।
চুন প্রয়োগের ৭ / ১০ দিন পরে গড়ে জলের প্রতি মিটার গভীরতার জন্য হেক্টর প্রতি ১৫০০ – ২১০০ কেজি (প্রতি ফুটে প্রতি বিঘায় ১০০ কেজি) মহুয়া খোল প্রয়োগ করতে হবে।
মহুয়া খোল প্রয়োগের ১০ / ১২ দিন পরে হেক্টর প্রতি ৪২০০ – ৫৫০০ কেজি (বিঘা প্রতি ৬৫০ – ৭০০ কেজি ) গোবর মেশাতে হবে।
এরও ১০ / ১২ দিন পরে ওই পুকুর বা জলাশয় মাছের চারা ছাড়ার উপযোগী হবে। মাছ ছাড়ার আগে জৈব জুস প্রয়োগ করলে ফল ভালো পাওয়া যাবে।
পাঙ্গাস মাছের চারা ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি -
বছর-ফেরি চারাপোনা সব থেকে ভালো। বর্ষা শেষে বা আশ্বিন – কার্তিক মাসে পোনা তৈরির বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া ভালো। অন্যান্য মাছের মতোই পাঙ্গাস মাছের বাচ্চাও বেশ স্বাস্থ্যবান, পুষ্ট, সতেজ হতে হবে। এদের মাথায় মুখের সামনে যে শুঁড় থাকে, তার উজ্জ্বলতা ও অখণ্ডতা সুস্বাস্থ্যের একটা সূচক।
একটু একটু গরম পড়ছে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে অর্থাৎ দোল পূর্ণিমার সময় বছর-ফেরি চারপানা পালন-পুকুরে ছাড়তে হয়।
নির্দিষ্ট সংখ্যার মাছ–চারা নিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা করে মৃত চারা থাকলে তাদের তুলে ফেলে সব মাছের ক্ষেত্রে যা যা করা হয়, অর্থাৎ তার স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ শেষে অবশ্যই ৩% সাধারণ লবণ জলে বা ফর্মালিন (৮ / ১০ ফোঁটা প্রতি লিটার জলে ) দ্রবণে ২ / ৩ মিনিট রেখে শোধন করতে হবে। প্রখর রোদ ওঠার আগে বা পড়ন্ত বেলায় মাছের চারাগুলি আস্তে আস্তে পুকুরের জলে ছেড়ে দিতে হবে। প্রতি ডেসিম্যালে ৫০ গ্রাম ওজনের ১০০-১৫০টি পাঙ্গাস মাছের সুস্থ সবল পোনা মজুদ এবং ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য ডেসিম্যালে প্রতি ৫-৬টি কাতলা বা সিলভার কার্প মাছের পোনা ছাড়তে হবে।
কার্প জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০টি পাঙ্গাস, ৮-১০টি রুই, ১০-১২টি সিলভার কার্প ও ৩০-৩৫টি মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ করলে বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়।
পরিচর্যা -
প্রতি সপ্তাহে ১-১.৫ কেজি তিন দিনের পুরোনো গোবর জলে গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দিলে মাছের প্রাকৃতিক খাবার ভালো তৈরি হয়। মাছের চারা ছাড়ার পর সাধারণত কোনও রাসায়নিক সার প্রয়োগের দরকার হয় না।
প্রতি মাসে অবশ্যই ডেসিম্যাল প্রতি ২৫০-৩০০ গ্রাম কলিচুন জলে গুলে ভালো করে পুকুরের জলে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে জলের পি এইচ পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো । তাছাড়া মাসে মাসে ১০০-১৫০ গ্রাম মোটা দানার লবন ( আয়োডিন বিহীন ) দিলে মাছ বেশ তরতাজা থাকে, পুকুরের তলদেশে কোনো গ্যাস তৈরি হতে দেয় না এবং মাছের রোগ প্রতিরোধে লবণ বেশ ভালো কাজ করে।
প্রতি মাসে খ্যাপলা ফেলে বা জাল টেনে মাছ পরীক্ষা করতে হবে। এতে মাছের ব্যায়াম হয়, বৃদ্ধি ভালো হয়।
সম্ভব হলে সপ্তাহে ২ / ১ বার জল পাল্টানো প্রয়োজন। এই সময় ২০%/৩০% ভাগ জল বের করে নতুন জল প্রবেশ করানো হয়। শীতকালে জল পাল্টানো অবশ্যই প্রয়োজন।
খুব ঠান্ডা এদের খুব পছন্দ নয়। এই সময় এদের খাওয়া ও চলাফেরা কমে যায়। এই সময় জলের উত্তাপ কমলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। শীতে কোনও রকম জাল টানা নিষিদ্ধ — কারণ কোনও ক্ষত এদের শরীরের পক্ষে ভালো নয়, বিশেষ করে মুখের শুঁড় দু’টি খুবই সংবেদনশীল। কোনও কারণে ক্ষত হলে এদের মৃত্যু হতে পারে।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
তথ্যসূত্র- ড. সুমন কুমার সাহু
Share your comments