প্রতাপ মুখোপাধ্যায় ও শ্রীপর্ণা চক্রবর্তীঃ পশ্চিমবঙ্গ কৃষিকাজ ও মাছচাষের দিক থেকে ভারতবর্ষের মধ্যে অন্যতম।এখানে মাছ চাষ অনেক বিস্মৃত। পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু ও পরিবেশের তারতম্য অনুযায়ী মিষ্টি জল,নোন জল,সামুদ্রিক ও পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন ঝোড়াতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হয়ে থাকে,যার স্থানীয় ও বৈদেশিক দু-ধরণের বাজারই আছে।মাছ চাষমূ লত: ছোট–বড়ো পুকুর , দীঘি,বিল ইত্যাদি জায়গায় হয়ে থাকে।
এই সবের পাশাপাশি উত্তর-২৪ -পরগনা , দক্ষিণ-২৪-পরগনা,পূর্ব-মেদিনীপুরে যেখানে মাছের একটি ভালো বাজার আছে সেখানে খালগুলিতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিকল্পনামাফিক মাছ চাষ করা সম্ভব । এই খালগুলি জলসেচের কাজেও লাগে যা পুরো কৃষিকাজের জলের চাহিদার ১৭ % পূরণ করে ও মাছ চাষের জন্য ভীষণভাবে উপযুক্ত। মূলত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্রসেচ দপ্তর অথবা জলসম্পদ দপ্তর থেকে মজা খাল থাকলে তা সংস্কার করানো অথবা নতুন খাল খনন করানো যেতে পারে।এই খালগুলিতে চাষীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন গ্রূপ তৈরির মাধ্যমে মাছ চাষ করে জীবন ও জীবিকা দুই নির্বাহ করতে পারেন। খালগুলির মধ্যেও দুটি ভাগ আছে ১) মরসুমি খাল ( যেগুলি বৃষ্টির জলধারণ করে ও ৬ মাস জল থাকে ),বহুবর্ষজীবীখাল ( সারা বছর জল থাকে)। গেছে যে উত্তর ও দক্ষিণ-২৪-পরগনা জেলার একটি অনেক বড়ো অংশ দখল করে আছে এইখালগুলি।যদি সঠিকভাবে এই খালগুলি পরিচালনা করা যায় তাহলে একটা বড়ো অংশের মানুষ এই খালে মাছ চাষ করে ও খালের জল তার পার্শবর্তী চাষের জমিতে ব্যবহারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন।খালগুলির পাড়ে কিছু সবজি ( শশা, কুমড়ো , ঢেড়শ, নারকেল ইত্যাদি ) লাগিয়ে ভূমিক্ষয় রোধ করে পাড়গুলিকে মজবুত রাখা যেমন সম্ভব তেমনএই সবজি চাষ থেকে কিয়দাংশে উপার্জনও সম্ভব, এবং এই কাজগুলিতে গ্রামের মহিলারা সহজেই অংশগ্রহণ নিতে পারবেন।
আরও পড়ুনঃ প্রথমে করতেন ভিক্ষে, নন্দীগ্রাম-১ ব্লক মৎস্য বিভাগের সহয়তায় আজ সফল মাছ বিক্রেতা
খালগুলির মধ্যে কিছু আছে মিষ্টি জলের খাল ও কিছু নোনা জলের খাল। এই খালগুলিতে চাষ করতে হলে প্রথমে আমাদের সেটি কি প্রকৃতির খাল তা নির্ধারণ করতে হবে, এরপর খালটিতে প্রতি ১ কিলোমিটার জলাশয়ের আয়তন অনুযায়ী সেটিকে বাঁশের পাটা ও নাইলন জাল দিয়ে ঘিরে একটি করে গ্রূপ তৈরি করে তাদেরকে সেখানে মাছ চাষে নিযুক্ত করা যেতে পারে।এইভাবে প্রতিটি খালের যা আয়তন তার ভিত্তিতে প্রতিটি খালপিছু যতগুলি গ্রূপ হচ্ছে তাদেরকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মাছ চাষে নিযুক্ত করতে হবে। এই ছোট ছোট গ্রূপগুলি নিয়ে একটি এসোসিয়েশন তৈরি করে সুষ্ঠূভাবে গ্রূপগুলি ও খালগুলি পরিচালনা করা যেতে পারে। খালের গভীরতা যেন মাছ চাষের উপযুক্ত (৬-৮ ফুট ) হয় সেটি অবশ্যই দেখে নিতে হবে। নোনা খালগুলিতে আমরা ভেটকি, পার্শে ইত্যাদি চাহিদাবান প্রজাতির মাছ চাষ করতে পারি , মিষ্টি জলের খালগুলিতে পলিকালচার হিসাবে গলদা চিংড়ি ও রুই –কাতলার চাষ করা যেতে পারে ,এছাড়াও পাবদা,গলদা চিংড়ির মনোকালচার করা যেতে পারে। খালগুলিতে চাষের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, যে খালগুলি নদীর সাথে যুক্ত অথবা যেগুলি বন্যায় ভেসে যায় সেখানে কখনোই তিলাপিয়া,পাঙ্গাস ইত্যাদি আক্রমনাত্বক (ইনভেসিভ) বা কোনো বৈদেশিক প্রজাতির মাছ চাষ করা যাবে না।
এই খালগুলিতে ছোট ছোট খাঁচাতে (Cage culture) শিঙি, কই, দেশি মাগুর, ট্যাংরা ইত্যাদি প্রজাতির মাছ চাষে মহিলাদের নিয়োজিত করা যেতে পারে। যদি অনেক বড়ো আয়তনের খালে কেউ চাষ করেন তবে সেক্ষেত্রে মাছ আহরণে ও খাল পরিচালনাতে অনেক সমস্যা হয়ে থাকে। সর্বশেষে বলা যায় আমাদের রাজ্যের প্রধান মাছ উৎপাদন জেলাগুলিতে যে বিপুল পরিমান আয়তনের খাল আছে সেগুলিকে সঠিক ব্যবহারের দ্বারা বিপুল কর্মসম্ভার ও মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
আরও পড়ুনঃ Kharif Crop: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব! ঝুঁকির মুখে খাদ্য নিরাপত্তা, বাড়ছে উদ্বেগ
খালে মাছ চাষের সাথে অর্থকারী ফসল হিসাবে মাখনা চাষ করা যেতে পার। মাখনায় প্রচুর শর্করা, ফ্যাট , প্রোটিন ও খনিজ পদার্থ থাকে। সহজপাচ্য বলে শিশুদের ও বয়স্কদের খাবার হিসাবে এর গুরুত্ব অশেষ। মাখনার ঔষধী গুণাবলীও আছে। লোকাল বাজারে ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা অপরিসীম।তবে মাখনা চাষের সাথে কার্প জাতীয় মাছ অথ বা শিঙি, মাগুর, কই ইত্যাদি প্রজাতির মাছ যাদের অক্সিজেনের চাহিদা কম ও বেশি তাপমাত্রা সহ্য করতে পার।মাখনা ও মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুরের জলের গভীরতা ও পুকুরের জলের নিকাশিব্যবস্থা যেন ঠিকথাকে সেটি দেখে নিতে হবে। মাছের মজুতের হার দেখে নিতে হবে।
শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী, মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক, মগরাহাট-২ ব্লক,দক্ষিণ -২৪ -পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তর,
প্রতাপ মুখোপাধ্যায়, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিজ্ঞানী , আই. সি. এ. আর., সি. আই. এফ. এ , ভুবনেশ্বর
Share your comments