মাছের উৎপাদন ও উৎকর্ষতার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই অগ্রণী রাজ্য। বহু প্রচলিত মাছ চাষ আমাদের প্রধান জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারে সুনিশ্চিত হয় জীবন প্রবাহ, পুষ্টি সুরক্ষা এবং সেই সঙ্গে উপার্জনও। মিষ্টি জলে সমন্বিত মিশ্র চাষ এখানে ব্যাপক হারেই হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা চিরাচরিত প্রথায় এবং উৎপাদনশীলতার দিক থেকে তা কিন্তু খুবই কম।
অনেকের কাছে বিঘা প্রতি ফলন বছরে একটন এখনও অধরাই রয়ে গেছে। এমনিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দীর্ঘতর গ্রীষ্মকাল, বর্ষার খামখেয়ালীপনা উৎপাদনশীলতাকে বাড়তে দিচ্ছে না আজকাল। কিছু সম্পন্ন প্রগতিশীল চাষী প্রযুক্তির প্রয়োগ করে বাড়তি ফলন পাচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ চাষীর এই ব্যাপারে সচেতনতা একটু কমই রয়ে গেছে। এটা ঠিক সামান্য প্রশিক্ষণ পেলে তাঁরাও বুঝতে পারবেন – একঘেয়েমি কায়িক শ্রমের কম প্রয়োগে কম সময়ে যে কোন মাছের খামারে উৎপাদন বাড়বেই আর সর্বোপরি জলাশয়ের পরিবেশও ভাল থাকবে। এই যে উৎপাদনে তারতম্য তার একটা কারণ প্রযুক্তিকৃত কৌশলকে ব্যবহার করা বা না করার জন্য। প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ বা সাধারণ কিছু যন্ত্রাদি/উপকরণ ব্যবহার করে কিরকম পরিচর্যা করলে জল নির্মল থাকবে, দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘাটতি হবে না, প্রাণীকনা পর্যাপ্ত থাকবে, পুকুরের নিচে ক্ষতিকর গ্যাস জমার সুযোগ দেওয়া যাবে না, অর্থাৎ জল ও মাটির প্রয়োজনীয় ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলী অনুকূলে থাকবে। জলে মাছের বাড়বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকবে, আর মাছের রোগবালাই সম্ভবনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সব মিলিয়ে পরিবেশবান্ধব মাছ চাষ উৎসাহী প্রান্তিক চাষীকেও নিরাপত্তা দেবে- গ্রামীণ বিকাশও হবে।
সাধারণ যন্ত্রাদির সহায়তায় প্রযুক্তির প্রয়োগের সাথে পরিচর্যা ঠিকমতো হতে পারে। জল ও মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনভিত্তিক চুন, জৈব সার, খাবার যোগান দেওয়া হল পদ্ধতি। এই সাথে উপযুক্ত দাম থেকে মাছের চারা সংগ্রহ করা দরকার (যে ফার্ম ও হ্যাচারীতে ব্রুড প্রতিপালন, ডিমপোনার গুণমান বজায় রাখার উপর নজর দেওয়া হয়।) তাহলে আশানুরূপ মাছের ফলন পাওয়া যাবে। জলে প্রাণীকনা ৫০ লিটারে ১-২ মিলি হলে বিঘা প্রতি ২৫-৩০ হাজার ধানীপোনা ছাড়া যেতেই পারে (২৫ মিলিলিটার ৫০০ টি ধানীপোনার ওজন সাধারণত ১৫০ গ্রাম হয়- গড়ে প্রতিটির ওজন ৩০০ মিগ্রা)। জলের ক্ষারকীয়তা/পিএইচ –এর উপর নির্ভর করে চুন প্রয়োগ করা দরকার। জৈব সারের প্রয়োগও হবে মাটির গুনাগুণ পরীক্ষার উপর নির্ভর করে, যতটুকু প্রয়োজন ঠিক তততুকুই। জলাশয়ের পরিবেশ ভালো রাখতে মাছ ছাড়ার আগে, পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ মজুতকালীন ও মজুত পরবর্তী অবস্থায় মাসিক মোট সার (জৈব ও অজৈব) যথাক্রমে ২০% এবং ১০% হারে প্রতি মাসে প্রয়োগ করতে হবে। এতে নিয়মিত প্রাণীকনার উপস্থিতি সুনিশ্চিত থাকে এবং খাবার প্রয়োগের হারও কম হয় – খরচ কমে, জল খারাপ হয় না, মাছের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা কমে।
আমাদের গ্রামে অফুরন্ত পুকুর ও নানা ধরণের জলাশয়ে সাধারণ কৃষির মত জল কৃষির মাধ্যমে মাছ উৎপাদন বাড়িয়ে তোলা সঙ্গত কারণেই দরকার এবং তা সম্ভবও সহজেই। আমাদের রাজ্যে তিনটি কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণাগার রয়েছে- ব্যারাকপুর, রহড়া ও সল্টলেক সেক্টর ৫-এ। এছাড়াও অতি দক্ষ মৎস্য দফতর, জেলার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র ও CADC বা সামগ্রিক আঞ্চলিক উন্নয়ন পর্ষদের দফতর আছে। এই সুযোগের সৎ ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদনে প্রযুক্তির প্রয়োগ করে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে কোন অসুবিধা বা বাঁধা থাকার কথা নয়। এর সাথে বিভিন্ন যন্ত্রাদির ও মাছ চাষের বিভিন্ন উপকরণ সমৃদ্ধি ‘অ্যাকোয়া শপ’ সমস্ত ব্লকে, পঞ্চায়েতে তৈরি হতে পারে, যেমন, ছড়িয়ে আছে কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতির সহস্র দোকান সারা রাজ্যে। এতে মাছের উপকরণ দিয়ে ব্যবসার এক দিগন্ত খুলে যেতে পারে গ্রামের শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কাছে স্বাবলম্বী হওয়ার। তারাও নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই সম্পদ কর্মীর কাজ করতে পারেন। একটি ব্লকে একজন মাত্র মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক আছেন, সঙ্গে হয়তো মৎস্য প্রযুক্তি সহায়ক এক বা দুজন থাকতে পারেন। মনে রাখতে হবে, একটি ব্লক মানে প্রায় ৫০ কিমি এরিয়া জুড়ে এক একটি অংশ।
আরও পড়ুন - Poultry Farming - জেনে নিন মুরগির উন্নত জাত ও তার পালন পদ্ধতি সম্পর্কে
সুতরাং, সমস্ত পঞ্চায়েত ও গ্রামের উন্নত মাছ চাষে সহায়তা যোগান সবসময় হয়তো সম্ভব হয় না- এই দক্ষ প্রশিক্ষিত মীনবন্ধুরা তাঁদের এলাকায় যোগাযোগ রেখে জলসম্পদের সদ্ব্যবহার, তথ্য প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকীকরণের সাহায্যে বিভিন্ন মাছের খাবার, জৈব ওষুধ/সার ইত্যাদি প্রয়োগে মাছ চাষে উন্নয়নের স্বার্থে রোজগারের দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
আরও পড়ুন - Coffee Cultivation process: অল্প বিনিয়োগে কফি চাষ করে বিপুল আয়ের পথ দেখছেন কৃষক বন্ধুরা
Share your comments