পাঙ্গাস মাছের গড় ফলন বা বৃদ্ধি অনেক বেশি; সাধারণ রুই, কাতলা, মৃগেল ফলনের প্রায় ৪/৫ গুণ। তাই ইদানীং অনেক চাষি পাঙ্গাস মাছ চাষে প্রায়শই আগ্রহ প্রকাশ করেন। জলাশয়ে পরিকল্পিতভাবে পাঙ্গাস মাছের চাষ করলে সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বিপুল সংখ্যক বেকার যুবক ও যুবতীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে ।
পাঙ্গাস মাছের চারা ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি (Management of Pangasius fish seedlings) -
বছর-ফেরি চারাপোনা সব থেকে ভালো। বর্ষা শেষে বা আশ্বিন – কার্তিক মাসে পোনা তৈরির বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া ভালো। অন্যান্য মাছের মতোই পাঙ্গাস মাছের বাচ্চাও বেশ স্বাস্থ্যবান, পুষ্ট, সতেজ হতে হবে। এদের মাথায় মুখের সামনে যে শুঁড় থাকে, তার উজ্জ্বলতা ও অখণ্ডতা সুস্বাস্থ্যের একটা সূচক।
একটু একটু গরম পড়ছে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে অর্থাৎ দোল পূর্ণিমার সময় বছর-ফেরি চারপানা পালন-পুকুরে ছাড়তে হয়।
নির্দিষ্ট সংখ্যার মাছ–চারা নিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা করে মৃত চারা থাকলে তাদের তুলে ফেলে সব মাছের ক্ষেত্রে যা যা করা হয়, অর্থাৎ তার স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ শেষে অবশ্যই ৩% সাধারণ লবণ জলে বা ফর্মালিন (৮ / ১০ ফোঁটা প্রতি লিটার জলে ) দ্রবণে ২ / ৩ মিনিট রেখে শোধন করতে হবে। প্রখর রোদ ওঠার আগে বা পড়ন্ত বেলায় মাছের চারাগুলি আস্তে আস্তে পুকুরের জলে ছেড়ে দিতে হবে। প্রতি ডেসিম্যালে ৫০ গ্রাম ওজনের ১০০-১৫০টি পাঙ্গাস মাছের সুস্থ সবল পোনা মজুদ এবং ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য ডেসিম্যালে প্রতি ৫-৬টি কাতলা বা সিলভার কার্প মাছের পোনা ছাড়তে হবে।
কার্প জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০টি পাঙ্গাস, ৮-১০টি রুই, ১০-১২টি সিলভার কার্প ও ৩০-৩৫টি মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ করলে বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়।
পরিচর্যা (Cultivation method & Care) -
প্রতি সপ্তাহে ১-১.৫ কেজি তিন দিনের পুরোনো গোবর জলে গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দিলে মাছের প্রাকৃতিক খাবার ভালো তৈরি হয়। মাছের চারা ছাড়ার পর সাধারণত কোনও রাসায়নিক সার প্রয়োগের দরকার হয় না।
প্রতি মাসে অবশ্যই ডেসিম্যাল প্রতি ২৫০-৩০০ গ্রাম কলিচুন জলে গুলে ভালো করে পুকুরের জলে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে জলের পি এইচ পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো । তাছাড়া মাসে মাসে ১০০-১৫০ গ্রাম মোটা দানার লবন ( আয়োডিন বিহীন ) দিলে মাছ বেশ তরতাজা থাকে, পুকুরের তলদেশে কোনো গ্যাস তৈরি হতে দেয় না এবং মাছের রোগ প্রতিরোধে লবণ বেশ ভালো কাজ করে।
প্রতি মাসে খ্যাপলা ফেলে বা জাল টেনে মাছ পরীক্ষা করতে হবে। এতে মাছের ব্যায়াম হয়, বৃদ্ধি ভালো হয়।
সম্ভব হলে সপ্তাহে ২ / ১ বার জল পাল্টানো প্রয়োজন। এই সময় ২০%/৩০% ভাগ জল বের করে নতুন জল প্রবেশ করানো হয়। শীতকালে জল পাল্টানো অবশ্যই প্রয়োজন।
খুব ঠান্ডা এদের খুব পছন্দ নয়। এই সময় এদের খাওয়া ও চলাফেরা কমে যায়। এই সময় জলের উত্তাপ কমলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। শীতে কোনও রকম জাল টানা নিষিদ্ধ — কারণ কোনও ক্ষত এদের শরীরের পক্ষে ভালো নয়, বিশেষ করে মুখের শুঁড় দু’টি খুবই সংবেদনশীল। কোনও কারণে ক্ষত হলে এদের মৃত্যু হতে পারে।
রোগ-পোকা (Disease Management) -
এই মাছে খুব বেশি রোগ-পোকার প্রাদুর্ভাব ঘটে না। তা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিন মাস বাদে বাদে মাছ তুলে নেওয়া হয়। তাই রোগে খুব ক্ষতি করতে পারে না। সুষ্ঠু পরিচর্যা ও নিয়মিত নুন, চুন প্রয়োগ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাই এই চাষের মূল মন্ত্র। প্রয়োজন হলে প্রতি ডেসিম্যাল পুকুরে ২৫ গ্রাম হলুদ প্রয়োগ করলে মাছের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বেড়ে যায়।
খাবার প্রয়োগ -
পালন-পুকুরে মাছের চারা ছাড়ার ২ / ১ দিন পর থেকে পরিপূরক খাবার দিতে হয়। প্রথম ৭ / ১০ দিন পর্যন্ত মাছের মোট ওজনের শতকরা ৩ ভাগ খাবার সকাল ৬ টা থেকে ৮ টার মধ্যে দিতে হয়। সারা দিনে এই সময় খাবার দেওয়া হয় এক বারই।
এর পর ৭ / ১০ দিন বাদ থেকে খাবারের পরিমাণ বাড়ানো হয় -- ওজনের শতকরা ৫ – ৮ ভাগ পর্যন্ত খাবার প্রয়োগ করা হয়। এই খাবার আস্তে আস্তে ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হয়। এদের ৯০ – ৯৫ দিন বয়স পর্যন্ত এই হারেই খাবার দেওয়া হয়। এর পর মাছের গায়ে চর্বি আসা অবধি এই বৃদ্ধি চলে।
মেঘলা হলে বা মাছ ঠিকমতো সব খাবার না খেলে খাবার দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। তাই সব সময় দৃষ্টি রাখতে হবে কোনও রকম অস্বাভাবিক আচরণ বা গতিবিধি মাছের হচ্ছে কি না।
পরিমিত খাবার -
ভাসমান খাবারই এদের খুব পছন্দ এবং এই খাবারই এরা খায়। সব থেকে ভালো খাবার পরীক্ষিত ভাসমান খাবার (বাজারে পাওয়া যায় ১ : ৩ : ১)।
মাছের ওজন ৪০০ – ৫০০ গ্রাম হলে বা চর্বি জমতে শুরু করলে বা ২ – ৩ মাস বয়সের পর থেকে সকালের খাবারে মটর সিদ্ধ (৬০%) ও বিকেলের খাবারে অল্প বাদাম খোল (৪০%) মিশিয়ে দিলে ভালো হয়।
উন্নত উপায়ে অর্থাৎ ভালো জলে, সঠিক পরিচর্যা করে, উপযুক্ত ও সঠিক খাবার প্রয়োগ করলে মাছের গুণমান অনেক বেড়ে যায়। এদের গায়ের রং, মাংসের রং, স্বাদ ও গন্ধ ভালো হয়।
জৈব জুস প্রয়োগ করলে মাছের উৎপাদন আরো ভালো পাওয়া সম্ভব। জৈব জুসে উপস্থিত কার্বন জলের অ্যামোনিয়া সহ ক্ষতিকারক গ্যাস দূর করে দেয় , উপকারী ব্যাক্টেরিয়া বা বন্ধু জীবাণু জলের তলার জৈব পদার্থকে মাছের খাবারে পরিণত করে। কিভাবে এই জুস তৈরি করতে হবে? ২৫ ডেসিমেল পুকুরের জন্য আড়াই কেজি বাদাম খোল, তিন কেজি চালের গুঁড়ো, ছয়শো গ্রাম ঈষ্ট পাউডার, তিন কেজি চিটে গুড় , দেড় কেজি আটা, তিনশো গ্রাম কলা ও দেড় কেজি যেকোনো পোনা মাছের খাবার একসাথে তিন গুণ জলের সাথে মিশিয়ে তিন দিন পচিয়ে পুকুরে দিতে হবে। মাসে দুবার করে জৈব জুস প্রয়োগ করা দরকার। জুস প্রয়োগের আগে চুন দেওয়া আবশ্যক।
ফসল তোলা বা মাছ ধরা (Harvesting) -
মাছ তোলা এবং বাজারজাত করার সময় ও পদ্ধতির উপর মাছ চাষের লাভক্ষতি অনেক অংশেই নির্ভর করে। তাই পাঙ্গাস মাছ ধরার জন্য কয়েকটি কথা মনে রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী ও বাজারের চাহিদার গুরুত্ব দিয়ে মাছ ধরতে হবে।
লাভের জন্য মনে রাখার বিষয় -
পাঙ্গাস মাছের স্থানীয় বাজারের চাহিদা যতক্ষণ মাছ জীবিত থাকে। মরা মাছের দাম অর্ধেক হয়ে যায়।
বছরে সাধারণত ৩ বার মাছ ধরা হয়।
স্থানীয় বাজারে ছোট (৪০০ – ১০০০ গ্রাম ) মাছের চাহিদা বেশি ।
এই মাছ প্রথম ৩ – ৪ মাস ভীষণ বাড়ে। যদি মাছের সংখ্যা কমানোর প্রয়োজন না থাকে, তবে মাছ ধরা স্থগিত রেখে মাছকে বাড়তে দিলে বেশি লাভ হয়।
গ্রীষ্মে এই মাছ বেশি বাড়ে। বৈশাখের শেষে বা জ্যৈষ্ঠ মাসে এদের ওজন ৭০০ গ্রামের ঊর্ধ্বে হয়ে যায়। এই সময় সমস্ত মাছ ধরে বাজারজাত করে নতুন ভাবে আবার বছর-ফেরি চারা মাছ (১৫ গ্রাম) জ্যৈষ্ঠ মাসে ছাড়লে, শ্রাবণের শেষে ৭০০ গ্রামের ঊর্ধ্বে ওজনের মাছ আবার তৈরি হয়ে যাবে।
শ্রাবণ মাসের শেষে দ্বিতীয় বার ফসল বিক্রি করে একই ভাবে তৃতীয় চাষ আরম্ভ করা যায়। এর পর পরিবেশ ঠান্ডা হতে থাকে, মাছের বৃদ্ধি ভালো হয় না।
তৃতীয় বারের মাছ যেহেতু শীতে বেশি বাড়বে না তাই আশ্বিনের শেষে ৩০০ – ৪০০ গ্রাম ওজনের মাছের শতকরা ৬০ – ৭০ ভাগ ধরে বাজারজাত করতে হবে। ওই স্থানে শতকরা ২৫ – ৩০ ভাগ পাঙ্গাসের চারার সঙ্গে বিঘা প্রতি ৬০০ – ৭০০ টি (৪০০০ – ৫০০০ প্রতি হেক্টরে) রুই, কাতলা (মৃগেল নয়) ছাড়া যেতে পারে।
ফাল্গুন মাসে গড়ে ৫০০ – ৬০০ গ্রাম হলে বিক্রয় করতে হবে। বড় মাছের স্বাদ বেড়ে যায়।
অনেকের বড় মাছ পছন্দ। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী এদের বাড়তে দেওয়া যেতে পারে।