ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (FAO) বিভিন্ন দেশকে ও জনগণকে মৌমাছি ও পরাগসংগ্রাহী পতঙ্গ সংরক্ষণ এর আর্জি জানিয়েছে, কারণ এই সকল পরাগসংগ্রাহী পতঙ্গদের অস্তিত্ব অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। মধুমক্ষী ও অন্যান্য পরাগসংগ্রাহী পতঙ্গরা পৃথিবীর প্রায় ৮৭ টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের পরাগসংযোগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি রাসায়নিক এর অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে এই বিশেষ কীট প্রজাতির অস্তিত্ব আজ বিপন্নের পথে। মৌমাছি না থাকলে বহু গাছের ফলন সম্ভব নয়, এমনকি সেই উদ্ভিদ প্রজাতি যেমন- আপেল, কফি, আমন্ড, টমেটো, পেঁয়াজ, ও কোকো গাছের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও FAO গুলি কীটনাশক ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য বিশেষ বিধিনিষেধ চালু করেছে, যাতে হয়তো উপকারী পতঙ্গদের হত্যা নিয়ন্ত্রণ হতে পারে ।
সচরাচর যে মৌমাছিগুলি দেখা যায়, তার বৈজ্ঞানিক নাম ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ-
পাথুরে মৌমাছি (এপিস ডর্সাটা): এরা ভালো মধু সংগ্রাহক এবং এদের প্রতি উপনিবেশ থেকে গড়ে ৫০-৮০ কেজি ফলন পাওয়া যায়৷
ক্ষুদে মৌমাছি : (এপিস ফ্লোরিয়া): এরা খুব কম মধু উৎপন্ন করে এবং প্রতি উপনিবেশ থেকে প্রায় ২০০-৯০০ গ্রাম মধু পাওয়া যায়৷
ভারতীয় মৌমাছি (এপিস সেরানা ইণ্ডিকা): এরা বছরে প্রতি উপনিবেশ থেকে গড়ে ৬-৮ কেজি মধু দেয়৷
ইউরোপিয় মৌমাছি (এপিস মেলিফ্লেরা): প্রতি উপনিবেশ থেকে গড়ে ২৫-৪০ কেজি মধু পাওয়া যায়৷ এগুলি ছাড়াও কেরলে আর একটি প্রজাতি পাওয়া যায় যারা "হুলবিহীন মৌমাছি" নামে পরিচিত৷ এরা আদৌ হুলবিহীন নয়, প্রকৃতপক্ষে এদের হুল পূর্ণ বিকশিত হয় না৷ তবে এরা খুব ভালো পরাগসংযোজক৷ এরা বছরে ৩০০-৪০০ গ্রাম মধু উৎপাদন করে৷।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ৫০০গ্রাম মধুর জোগাড় করতে মৌমাছিদের ২ মিলিয়ন ফুলের দরকার হয়। এক চা চামচ মধুতে (২১গ্রাম) ৬৪ ক্যালোরি ও ১৭ গ্রাম শর্করা তৎসঙ্গে সুক্রোজ, ফ্রুকটোশ, গ্লুকোজ, মেলটোশ প্রভৃতি থাকে। এছাড়া খাঁটি মধু ভালো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট (প্রতিরোধক) হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ডায়াবেটিস, রক্ত চাপ, হৃদ রোগ, মেদ কমাতে এর জুড়ি মেলা ভার। এছাড়া মৌচাক থেকে প্রাপ্ত মোম গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে ও রূপচর্চার কাজে লাগানো হয়। তাই মধু নিয়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট এবং বড় ব্যবসার সম্ভাবনা আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
সারা দেশেই মৌমাছি পালনে এখন গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে ফুলে ফুলে যে নেক্টার উৎপন্ন হয়, সরকার তার সুচারু ব্যবহারের প্রস্তাব রেখেছেন।
নেক্টারের সুচারু ব্যবহার আসলে কি?
সপুষ্পক উদ্ভিদে ফুল থেকে পুষ্পরস বা নেক্টার নিঃসরণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পরাগমিলনকারী পতঙ্গকে আকর্ষণ করতেই মূলতঃ এই মিষ্টিরস ব্যবহৃত হয়। এই নেকটারের একটা বড় অংশ যদি মৌমাছি পালনের বৃদ্ধি ঘটিয়ে আমরা সংগ্রহ করতে পারি, দেশে মধু উৎপাদনে বিপুল অগ্রগতি ঘটতে পারে। শুধু তাই না এই উদ্যোগ সফল করতে পারলে পরাগ মিলনের উন্নতি ঘটিয়ে, দেশের কৃষি উৎপাদনেও বিপুল অগ্রগতি ঘটানো সম্ভব। পরাগমিলনে অন্যান্য পতঙ্গের তুলনায় মৌমাছি বেশী দক্ষ। কারণ মৌমাছি শুধু নিজের প্রয়োজন মেটাতে নেকটার সংগ্রহ করে না, চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত সংগ্রহ করে, মধু রূপে মৌচাকে জমা করে অসময়ের জন্য বা সন্তান সন্ততির জন্য। অন্যান্য কীটপতঙ্গের তুলনায় মৌমাছি ফুলে ফুলে বেশী ধাবন করে, ফলে পরাগ মিলনে সাহা্য্য বেশী হয়।
মৌমাছির বৈচিত্র্য : পৃথিবীতে এখনও পর্য্যন্ত ২০,০০০ মত প্রজাতির মৌমাছি চিহ্নিত করা গেছে। বাক্স বন্দী করে যে মৌমাছিগুলি পালন করা হয় তা মূলতঃ তিন প্রজাতির-
১. এপিস মেলিফেরা: এই মৌমাছির মধু উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশী, বছরে বাক্স প্রতি প্রায় ৪০ কেজি। উৎপাদন ও পরিচর্যা ব্যায় অনেক বেশী। নেকটার সমৃদ্ধ ফুলের লভ্যতার ওপর নির্ভর করে মৌমাছি স্থানান্তর করে এই মৌমাছির চাষ করতে হয়।
২. এপিস সেরানা ইন্ডিকা: এশিয়াঞ্চলের মৌমাছি এদের মধু উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কম। বাক্স প্রতি বছরে প্রায় ৪ কেজি। কিন্তু বাক্স স্থানান্তর না করেই এই মৌমাছি চাষ করা যায়। উৎপাদন ব্যয়ও অনেক কম।
৩. হুল বিহীন মাছি: এরা এপিসগণ ভুক্ত নয়। সামান্য পরিমানে মধু সংগ্রহ করে। গাছের কোটরে বা বাড়ি ঘর দোরের ফাটলের মধ্যে এরা চাক বাঁধে। এদেরও বাক্স বন্দী করে চাষ করা যায়। মধু উৎপাদনের চাইতে আচ্ছাদনের চাষ (protected cultivation) –এ ফসলের পরাগ মিলনে এই মাছি অনেক বেশী কার্যকরী।
এছাড়া বাক্সবন্দী করা যায় না এমন অনেক মৌমাছিও রয়েছে। বড় গাছে মস্ত মস্ত চাক বেঁধে থাকে সাধারণত: এপিস ডরসাটা। এরা ডাশ মাছি। আর অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট মাছি হল এপিস ফ্লোরেয়া।
মৌমাছির খাদ্য:
(ক) নেকটার ও মধু: নেকটার তরল মিষ্টি রস। এই রসকে মধুতে রূপান্তরিত করে মৌমাছি, যা অপেক্ষাকৃত ভাবে অনেক ঘন। মধুতে জলীয় অংশ থাকে ২০% এর মধ্যে। মৌপ্রকোষ্ঠে জমা করার সময়, মৌমাছি যদি বোঝে, মধুতে জলের অংশ বেশী আছে, তবে ডানা ঝাপটে ঝপটে তারা জলীয় অংশ কমায় ও মৌপ্রকোষ্ঠটিতে ঢাকনা দিয়ে দেয়। এই মধু সহজে নষ্ট হয় না।
(খ) পোলেন বা পরাগরেণু: নেকটার থেকে মৌমাছির প্রোটিনের চাহিদা মেটে না। সেটা মেটে পরাগরেণু বা পোলেন থেকে। মৌমাছির গায়ের লোমে আটকে থাকা পোলেন যেমন পরাগমিলনের কাজে লাগে, তেমনি কিছু পোলেন জিভ দিয়ে ভিজিয়ে জড়ো করে পেলনের পা জোড়ায় থাকা কোটরে জমা করে ও মৌচাকে গিয়ে জমা করে। এই পোলেনগুলো মধুতে ভিজিয়ে নিয়ে চাকের মধ্যে নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে জমা করে। এদের বলে পরাগরুটি বা পোলেন ব্রেড। মৌমাছির শাবকের জন্মের কয়েকদিন পর থেকেই এদের পরাগরুটি খেতে দেওয়া হয়।
(গ) রয়াল জেলি: মৌমাছির সমাজের ক্রম ও শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে কমবেশী আমরা সবাই অবহিত। এই সমাজ মূলতঃ রাণী কেন্দ্রীক। রাণীর কাজ শুধুই ডিম পাড়া। এরপর দু তিন দিনের মধ্যেই শাবকেরা বেরিয়ে আসে। মৌমাছির ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা (যারা ধাত্রী মাছির কাজ করে) শাবকদের দায়িত্ব পালন করে। তাদের হাইপোফ্যারিঞ্জিয়াল গ্রন্থী থেকে এক ধরণের জেলি জাতীয় পদার্থ নিঃসৃত হয়। সেই জেলি তারা সন্তান প্রকোষ্ঠগুলিতে খাদ্য হিসেবে ফেলে রাখে। জন্মের পর প্রথম দু/ তিন দিন সবার জন্যই এই খাদ্য বরাদ্দ থাকে। তারপর শাবকদের জন্য বরাদ্দ হয় পরাগরুটি। কেবলমাত্র যে শাবক হবে ভবিষ্যতের রাণী, তার জন্য সারাজীবন ব্যাপী বরাদ্দ এই রয়াল জেলি। নানা ধরনের মিনারেল, ভিটামিন, প্রোটিন সমৃদ্ধ এই খাদ্য। কিন্তু অধুনা বিজ্ঞানীদের নজরে এসেছে, আসলে পোলেন ও মধু না খাইয়েই রাণী তৈরী করা হয়। রয়াল জেলির গুণে শাবক ভবিষ্যতের রাণী হয় না, এটা আসলে জিন নিয়ন্ত্রিত একটি পদ্ধতি। বিষয়টি অবশ্য এখনো বিতর্কের উর্ধে নয়।
আজকাল এই রয়াল জেলিও বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহার্ঘ খাদ্য হিসেবেই, পৃথিবীব্যাপী এখন এর চাহিদা।
আর কি উৎপন্ন করে মৌমাছি?
১. চাক বাঁধার জন্য মৌমাছি নির্দিষ্ট গ্রন্থী থেকে মোম উৎপন্ন করে। চাক ভাঙ্গার পর সেই মোম নিষ্কাশন করে বাজারে বিক্রী করা যায়। মৌপালকেরা এই ভাবে উৎপাদিত মোম সব সময় বাজারে বিক্রী না করে নতুন মৌমাছির ফ্রেম তৈরী করার জন্য ব্যবহার করে। ফলে, নতুন কলোনী স্থাপন করার সময়, মৌমাছিকে মোম উৎপাদনের জন্য বাড়তি সময় ও শক্তি ব্যবহার করতে হয় না। মধু উৎপাদনও এর ফলে সহজ হয়।
২. মৌ-বিষ: মৌমাছি সন্ত্রস্ত বোধ করলে শত্রুকে আক্রমণের জন্য হুল ব্যবহার করে। এই হুল ফুটিয়ে শত্রুর শরীরে বিষথলি থেকে তারা বিষ ফেলে দেয়। অবশ্য ফোটানোর পর এই হুল তারা বের করতে পারে না, হুল ওপর থাকা এক ধরণের কন্টক সজ্জার জন্য। শরীরের একটা অংশ ছিঁড়ে তাকে মুক্ত হতে হয় এবং সে মারা যায়।
এই মৌ বিষ খুব সহজেই আমরা নিষ্কাশন করে বাজারজাত করতে পারি। ঔষধিশিল্পে এর চাহিদা প্রচুর। মৌ বিষের অ্যান্টি কোয়াগুলেন্ট বৈশিষ্ট্য থাকায় তা মানুষের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা হয়।
৩. প্রোপালিন: গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে নিঃসৃত আঠা মৌমাছি সংগ্রহ করে লালা ও মোমের সাথে মেশায়। এই মিশ্রণ তারা মৌমাছির বাক্সের ফাটল, ফাঁক ফোকরে সংগ্রহ করে ফাটল বন্ধ করার জন্য ব্যবহার করে।
সারা পৃথিবীতেই পরাগ মিলনকারী পোকা ও বিশেষ করে মৌমাছির সংখ্যা কমছে। এটা শুধু মধু উৎপাদন নয়, শস্য উৎপাদনেরও ভয়ঙ্কর ক্ষতি করছে। বলা যায় এভাবে চললে স্বপুষ্পক উদ্ভিদের অস্তিত্বই বিপদাপন্ন হবে। মূলতঃ কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার, কীটনাশক বিশেষতঃ নিওনি কটিনয়েডসের ব্যবহার, কৃষিজমিতে বিপুল পরিমানে আগাছানাশকের ব্যবহার, জঙ্গল কমে আসা ও নগরায়নের ব্যাপ্তি পৃথিবী ব্যাপী এক জাতীয় পতঙ্গের সংখ্যা হ্রাসের কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই মৌ-পালন বাড়িয়ে তোলা অত্যাবশ্যকীয় বটে।
তথ্যসূত্র - ড. শান্তনু ঝা
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
Share your comments