বাণিজ্যিক ভাবে মাছচাষ (Fish farming) গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা হিসেবে পরিচিত। আর মাছ চাষের ৬০-৮০% খরচ ব্যয় করতে হয় মাছের খাদ্যের ওপর। তাই খাদ্যের এফসিআর ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণার প্রয়োজন। আধুনিক মাছ চাষে মাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সম্পূরক খাদ্য। আর এই মাছের খাবারের আধুনিক প্রযুক্তি হল ভাসা খাবার। এই খাদ্য জলে ভেসে থাকতে পারে, ফলে মাছের খেতে সুবিধা হয়। কিন্তু সাধারন মাছ চাষিদের এই খাবার প্রয়োগ সম্পর্কে সম্যক ধারনা তেমন নেই। তাই মাছের ভাসমান খাদ্য প্রয়োগ সম্পর্কে মৎস্য দপ্তরের সরকারী নির্দেশিকা ধরে আলোচনা করা হল।
মাছ চাষে এফ সি আর হল খাদ্য রূপান্তর হার, অর্থাৎ ১ কেজি মাছ উৎপাদন করতে কত কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয় তার অনুপাতকেই খাদ্যে এফ সি আর মান বলা হয়। উদাহরন স্বরূপ বলা যায়, এক কেজি মাছ উৎপাদন করতে যদি ১.৫ কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয় তাহলে উক্ত তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাছের এফসিআর হবে ১: ১.৫। খাদ্যের এফসিআর মান জানলে এক কেজি মাছের উৎপাদন খরচ কত তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়।
পুকুরে মাছের দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয় গুলির উপর নজর রাখতে হবে -
-
পুকুরে মাছের চারা ছাড়ার সংখ্যা, মাছের বাঁচার হারের ওপর নির্ভর করে মাছের খাবার দিতে হবে।
-
প্রতি ১৫ দিন অন্তর মাছের গড় ওজন নিয়ে প্রতিদিনের গড় বৃদ্ধির হার নির্ণয় করে খাদ্য তালিকা অনুযায়ী মাছের জন্য প্রতিদিন কত খাদ্য দরকার তা নির্দ্ধারন করতে হবে।
-
জলের তাপমাত্রার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। কারন তাপমাত্রার তারতম্য মাছের খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ২৮-৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা মাছ চাষের অনুকূল পরবেশ। তাপমাত্রা কমে গেলে মাছ খাদ্য কম করে। প্রতি ৭-১০ দিন অন্তর জলের স্বচ্ছতার উপর নজর রাখতে হবে। জলের স্বচ্ছতা ৩০-৪০ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকা দরকার। জলের স্বচ্ছতা খুব কমে গেলে এবং জলের রঙ ঘন সবুজ হলে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম হবে, ফলে মাছের খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। নিয়মিত জলের অক্সিজেন মাত্রার উপরও নজর রাখতে হবে।
-
নিয়মিত জলে চুন প্রয়োগ করে জলের পি এইচ মাছ চাষের অনুকূল রাখতে হবে।
কয়েকটি উদাহরন দিয়ে মাছের ঠিক কতখানি খাদ্য প্রয়োজন, তা খাদ্য তালিকা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা যাক -
ধরা যাক, একটি পুকুরে ১০০০ টি ২৫ গ্রাম ওজনের চারা পোনা ছাড়া হয়েছে। তাহলে ২৫ গ্রাম মাছের জন্য প্রতিদিন ২ গ্রাম খাদ্য দরকার। তাহলে ১০০০ টি মাছের জন্য প্রতিদিন খাদ্য দরকার ১০০০ X ২ গ্রাম = ২০০০ গ্রাম বা ২ কেজি । পুকুরে মাছের জন্য ২ খাদ্য দরকার। পুকুরে প্রতিদিন দুবার খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে । সকাল (৬.৩০ – ৭.৩০) ১ কেজি ও বিকেল (৩.৩০- ৪.৩০) ১ কেজি খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
আবার পুকুরে ১০০০ টি ২৫ গ্রাম ওজনের চারা পোনা ছাড়ার ৬০ দিন পর প্রতি মাছের ওজন যদি ১৬০ গ্রাম হল এবং মাছের বাঁচার হার ৯০ শতাংশ হল (অর্থাৎ ৯০০ টি মাছ বেঁচে আছে ) তাহলে খাদ্য তালিকা অনুযায়ী একটি ১৬০ গ্রাম মাছের জন্য ৪ গ্রাম খাদ্য দরকার ।
তাহলে ৯০০ টি মাছের জন্য খাদ্য দরকারঃ ৯০০X ৮ গ্রাম = ৩৬০০ গ্রাম বা ৩ কেজি ৬০০ গ্রাম। তাহলে পুকুরে মাছের জন্য প্রতিদিন ৩কেজি ৬০০ গ্রাম খাদ্য দরকার। পুকুরে প্রতিদিন দুবার করে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। সকালে (৬.৩০-৭.৩০) ১ কেজি ৮০০ গ্রাম ও বিকেলে (৩.৩০-৪.৩০) ১ কেজি ৮০০ গ্রাম খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
খাদ্য ছড়ানোর পর মাছ চাষিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে মাছেরখাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে হবে।
যদি দেখা যায় খাদ্য প্রয়োগের ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত খাদ্য মাছ খেয়ে নিয়েছে, তবে বুঝতে হবে খাদ্যের পরিমাণ ঠিক আছে। যদি খাদ্য সম্পূর্ন না খেয়ে থাকে তবে পরবর্তী সময়ে (দুপুর বা বিকাল) খাদ্যের পরিমাণ কমাতে হবে।
অনুরূপভাবে পরবর্তী সময়েও (দুপুর বা বিকাল) দেখতে হবে ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত খাদ্য মাছ খেয়ে নিয়েছে কি না ? যদি খাদ্য সম্পূর্ণ না খেয়ে থাকে তবে পরবর্তী সময়ে খাদ্যের পরিমাণ কমাতে হবে। আর যদি দেখা যায় খুব তাড়াতাড়ি মাছ খাদ্য খেয়ে নিয়েছে এবং খাদ্যের জন্য ঘোরাঘুরি করছে তাহলে পরবর্তী সময়ে খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য পুকুরে পাড় দিয়ে পুকুরের জলের চারিদিকে সমপরিমাণ হারে ছড়িয়ে দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, হাওয়ার প্রতিকূলতায় ভাসমান খাদ্য যেন পুকুরের কিনারায় চলে না আসে।
খাদ্য প্রয়োগের কয়েকদিনের মধ্যে যদি দেখা যায় কোন পুকুরে কোন একটি অঞ্চলে মাছ আনুপাতিক হারে বেশী আছে এবং খুব তাড়াতাড়ি খাদ্য খেয়ে নিচ্ছে তবে সেই অঞ্চলে একটু বেশী পরিমাণ খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
অনুরূপভাবে যদি দেখা যায়, কোন পুকুরের কোন একটি অঞ্চলে মাছ আনুপাতিক হারে কম আছে এবং খাদ্য ভেসে থাকছে অর্থাৎ ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত খাদ্য খাচ্ছেনা তাহলে সেই অঞ্চলে কম পরিমাণ খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
নৌকা বা ভেলা তৈরি করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য জলে সমপরিমাণ হারে ছড়িয়ে দিতে হবে। সর্বদা একটি বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখতে হবে যে খাদ্য সব সময় নির্দিষ্ট অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে কারন মাছ কিছু দিনের মধ্যে ঐ নির্দিষ্ট অঞ্চলে খাদ্য খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
যেহেতু মাছ ভাসমান খাদ্য গ্রহনে অভ্যস্ত নয় তাই প্রথম কয়েকদিন মাছের এই খাদ্য গ্রহণ করতে কিছু বেশী সময় লাগবে। কয়েকদিন পরে মাছ এই খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে যাবে এবং খুব তাড়াতাড়ি খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে। এই বিষয়টির দিকেও মাছ চাষিকে নজর রাখতে হবে।
আরও পড়ুন - Barbari Goat – এই জাতের ছাগল পালনের পরিকল্পনা করছেন? কীভাবে করবেন, জেনে নিন পদ্ধতি
শীতকালে অর্থাৎ জলের তাপমাত্রা কমে গেলে মাছ চাষিকে এই খাদ্য তালিকার পরিবর্তন করে নিতে হবে। শীতকালে দিনে একবার বা দুবার খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। খুব সকালে জলের তাপমাত্রা কম থাকে তখন খাদ্য প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। জলের তাপমাত্রা যখন বাড়তে থাকবে অর্থাৎ দুপুর ১১-১২ টার মধ্যে সকালের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যের ৫০-৬০ শতাংশ প্রয়োগ করে দেখতে হবে মাছ এই পরিমাণ খাদ্য খেয়ে নিচ্ছে কিনা ? যদি খাদ্য প্রয়োগের ৩০ মিনিট পরেও জলের উপর খাদ্য ভাসতে থাকে তবের বিকালের খাদ্য প্রয়োগের উপর নজর দিতে হবে। এই ভাবে মাছ চাষি পর্যবেক্ষণ করে শীতকালে মাছের খাদ্য তালিকার পরিবর্তন করে নিতে পারবে।
সর্বোপরি মাছ চাষীর অভিজ্ঞতা, পুকুরের পরিবেশের ও মাছের খাদ্য গ্রহণের চাহিদার উপর ভিত্তি করে মাছ চাষী এই খাদ্যের পরিমাণ পরিবর্তন করতে পারে।
আরও পড়ুন - Datura Farming - এই মরসুমে ধুতুরা চাষ আপনাকে দিতে দিতে পারে প্রচুর অর্থ
Share your comments