নদীর মাছ পেংবা, বৈজ্ঞানিক নাম “অস্টিওব্রামা বেলাঙ্গিরি”। মায়ানমারের চিন্দুইন নদী বয়ে পরিযায়ী পেংবা মাছ ভারতের মনিপুর উপত্যকায় এসে বাচ্চা দেয় ও বড় হয়। তাই মনিপুরের নাম্বুল নদী, ইম্ফল নদী, লোকটাক লেকে পাওয়া যায় পেংবা। এই নদী লেকেই পেংবা মাছের দেখা মেলে। তবে দেখা মেলে বলাটাও খানিকটা ভুল হবে, কারণ, পেংবা মনিপুর রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া মাছের মধ্যে পড়ে গেছে। যদিও মনিপুরের রাজ্য মাছের স্বীকৃতি পেয়েছে এই মাছ। শুধু স্মারক স্বীকৃতিই নয় , মনিপুর রাজ্যের মানুষের কাছে অতি প্রিয় ও পরিচিত পেংবা মাছ । অতুলনীয় স্বাদে চাহিদাও খুব ভালো। মনিপুরের বাজারে প্রায় পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয় মাছটি। মনিপুরের স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে পেংবা। তাই প্রতি বছর মনিপুরে “পেংবা দিবস” পালন করা হয়। মাছ প্রিয় বাঙালীদের পাতে যে পেংবা অচিরে স্থান করে নেবে, এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। সর্বোপরি মাছের সার্বিক উৎপাদন বাড়াতে রুই, কাতলার সাথে সাথী ফসল হিসেবে পেংবা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ভারতের মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের সাফল্যে বর্তমানে পেংবা মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা গেছে। তাই নতুন করে এই মাছের বাণিজ্যিক চাষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। “রাষ্ট্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র” সিফাতে মৎস্য বিঞ্জানী ডঃ প্রতাপ দাস পেংবা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়েছেন। সিফায় অজস্র পেংবার বাচ্চা তৈরি করেছেন এখানকার মৎস্য বিজ্ঞানিরা। একেকটির ওজন আনুমানিক ০.৫ গ্রাম।
পেংবা শীত প্রধান অঞ্চলের মাছ হলেও আমাদের এই পরিবেশে মাছটি বেঁচে থাকে অনায়াসেই। প্রায় এক বছরে পেংবা ওজনে ৪০০-৫০০ গ্রাম দাঁড়ায়। আড়াইশো গ্রামের থেকেই বাজারজাত করা যায় পেংবা। “অ্যাজোলা” খাওয়ালে পেংবা মাছের ভালো বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার হার বেশি পাওয়া যায়।
তবে কিভাবে চাষ করা যায় এই পেংবা মাছ ? আমাদের কার্প জাতীয় মাছের সাথে সহজেই পেংবা মাছের মিশ্র চাষ করা যায়। পেংবা রাক্ষুসে ধরনের মাছ নয়, শাকাশি জাতীয়। ছয় জাতীয় মাছের মিশ্রচাষে গ্রাসকার্প এর জায়গায় পেংবা মাছ ছাড়তে হবে। অর্থাৎ রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্প ও পেংবা । বড় পুকুরে চাষের জন্য হেক্টর প্রতি পুকুরে ৭০০০-৮০০০ টি পেংবা মাছের চারাপোনা মজুদ করা যায় । এবং এক বছরে ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজন হয়, যা বিক্রি যোগ্য। পেংবা মাছের বৃদ্ধি এমনিতে সাধারন বা কম হলেও যেহেতু বাজারমূল্য অনেক বেশি, তাই সাথী ফসল হিসেবে পেংবার মিশ্র চাষ অধিক লাভজনক। আতুঁড় পুকুরে চাষের জন্য প্রতি হেক্টর জলাশয়ে ৩-১০ মিলিয়ন ডিমপোনা ছাড়তে হবে। তবে পুকুরে বায়ুসঞ্চালনের ব্যাবস্থা করলে ১০-২০ মিলিয়ন / হেক্টর ডিমপোনা ছাড়া যাবে। কৃত্রিম খাবার হিসেবে চালের কুঁড়ো ও বাদামখোল এর গুঁড়ো সমান অনুপাতে মিশিয়ে দিতে হবে।
পালন পুকুরে চারাপোনার চাষের জন্য কার্প জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষ করা যাবে। ৭০-৮০ শতাংশ মাছের বাঁচার হার পাওয়া যাবে। উপযুক্ত, সুষম সমৃদ্ধ মাছের খাবার পেলে উচ্চ বেঁচে থাকার হার (৯৪.৫% শতাংশ) এবং মাছের ভালো বৃদ্ধি (৭৮৫ কেজি / হেক্টর) তিন মাস পালন করে তা অর্জন করা যেতে পারে।
সাধারণ পুকুরে চাষের জন্য যদি মে মাস নাগাদ ডেসিম্যাল পিছু ৩০০ গ্রাম ওজনের কাতলা ৩টি , ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের সিলভার কার্প ৩ টি, ৫০-১০০ গ্রাম ওজনের রুই মাছ ৩০টি, ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের ২০ টি মৃগেলের সাথে ২-৭ গ্রাম ওজনের পেংবা মাছ ১৫টি মজুদ করা যেতে পারে। তিন মাস পরে ৬০০ গ্রাম ওজনের রুই ও ১ কেজি ওজনের সিলভার কার্প হবে। সেগুলো বিক্রি করে দিতে হবে। পুনরায়, ১০০ গ্রাম ওজনের রুই মাছ ৪০ টি ও ২০০ গ্রাম ওজনের সিলভার কার্প ২টি মজুদ করতে হবে। এরপর মাছ ছাড়ার ৪-৫ মাস পর, ১২০০-১৫০০ কেজি কাতলা , ৪০০ গ্রাম ওজনের পেংবা মাছ ধরে বিক্রি জাত করা যেতে পারে এবং ধীরে ধীরে বাজার অনুযায়ী বাকি মাছ গুলো ধরে বিক্রি করে দিলে ভালোই লাভ হবে।
জৈব জুস প্রয়োগ করলে মাছের উৎপাদন আরো ভালো পাওয়া সম্ভব। জৈব জুসে উপস্থিত কার্বন জলের অ্যামোনিয়া সহ ক্ষতিকারক গ্যাস দূর করে দেয় , উপকারী ব্যাক্টেরিয়া বা বন্ধু জীবাণু জলের তলার জৈব পদার্থকে মাছের খাবারে পরিণত করে। কিভাবে এই জুস তৈরি করতে হবে? ২৫ ডেসিমেল পুকুরের জন্য আড়াই কেজি বাদাম খোল, তিন কেজি চালের গুঁড়ো, ছয়শো গ্রাম ঈষ্ট পাউডার, তিন কেজি চিটেগুড়, দেড় কেজি আটা, তিনশো গ্রাম কলা ও দেড় কেজি যেকোনো পোনা মাছের খাবার একসাথে তিন গুন জলের সাথে মিশিয়ে তিন দিন পচিয়ে পুকুরে দিতে হবে। এভাবেই সম্পূর্ন জৈবিকপদ্ধতিতে রুই , কাতলা , মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্পের সাথে “পেংবা” মাছের বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক চাষ করা যায়।
হলদিয়াতে এই পেংবা মাছের ব্যাপক অর্থে বাণিজ্যিক চাষ চলছে। রুই, কাতলার মতো কার্প জাতীয় মাছের কম্পোজিট ফার্মিং- এ সাথী ফসল হিসেবে “পেংবা” দ্রুত মাছ চাষিদের কাছে যেমন জনপ্রিয় হচ্ছে, তেমন বাঙালীর পাতে এক নতুন মাছের স্বাদ সংযোজন করছে। ইতি মধ্যে বেশ কিছু হ্যাচারী মালিক যোগাযোগ শুরু করেছে। পেংবার প্রজননে মাছ চাষিদের কাছে এই মাছ অতি সহজলভ্য হয়ে উঠবে।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
তথ্যসূত্র - সুমন কুমার সাহু (মৎস্যচাষ সম্প্রসারন আধিকারিক, হলদিয়া)
Share your comments