কৃষিজাগরন ডেস্কঃ উত্তর দিনাজপুর জেলায় কালিয়াগাঞ্জে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গ্রামন্নয়ন দপ্তরের অধীনে সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন বেশ কয়েকটি মহিলা দল, এদের বেশির ভাগই হেমতাবাদ ও বিষ্ণুপুর জি.পি.-র অন্তর্গত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভোগ্রাম স্বর্ণজয়ন্তী মহিলা দল, মাধবপুর তাজমহল মহিলা গোষ্ঠী, কাকর্সিং লক্ষী স্বর্ণজয়ন্তী মহিলা দল, দেহুছি করপাড়া প্রত্যাশা দল, কালিয়া গঞ্জ ব্লক মহিলা সঙ্গ, সমাজ সেবী স্ব্নির্ভর মহিলা দল, রামপুর খাজা স্বর্ণজয়ন্তী মহিলা দল ও পশ্চিমকালীমপুর বিশ্বকর্মা মহিলা দল।
অনুরূপভাবে, পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক প্রকল্পে ডাঃ উত্তম লাহা মহাশয়ের তত্বাবধানে কাজ করে চলেছেন ২০টি মহিলা গোষ্ঠী, এদের প্রত্যেকেই প্রথম পদখ্যেপ হিসাবে কার্প বা পোনা মাছের প্রণোদিত প্রজননের মধ্যমে এই দপ্তরে অবস্থিত হ্যাচারিতে ডিম ফোটানো ও বিভিন্ন মাছের চারা উত্পাদনের কাজ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। নিষ্ঠাভরে এঁরা ব্রুড মাছের পরিচর্যার কাজ নিজেদের তত্বাবধানে করে থাকেন। স্থানীয় মাছ চাষীরা এমনকি অন্য স্বনির্ভর দলও এখান থেকে পোনা নিয়ে সঠিক ভাবে প্রস্তুত করা পুকুরে লালন করে নিজেদের জীবিকার মান উন্নয়ন এবং নিয়মিত আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ মাছ চাষে ব্যয় সংকোচনেই কৃষকের আয় বৃদ্ধি-পর্ব এক
সমবায় ব্যাঙ্ক, হাওড়া উলুবেরিয়াতে বানিবন এবং হাওড়া জগদীশপুর সমবায় ব্যাঙ্ক। বেশ কিছু মহিলা স্ব্নির্ভর গোষ্ঠীকে মাছের পরিপূরক খাবার তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে ও ব্যাঙ্কের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান ও খাবার তৈরির হাত চলিত মেশিন যোগান দেওয়ায় প্রত্যেক দলই নিয়মিত খাবার তৈরি করছেন, প্যাকেজিং করছেন এবং স্থানীয় মাছ চাষীদের ও এমনকি মাছের পরিপূরক খাবার প্রস্তুত করে নেওয়া শুধু যে চাষে খরচ কমানো তাই নয়,মহিলা স্ব-শক্তিকরণ পরিযোজনার একটি সফল রূপায়্নও বটে।মাছের খাবার প্রস্তুতি ও তার বিপননের প্রকল্প রুপায়নে সহযোগিতা করে চলেছেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নামখানা সমবায় ব্যাঙ্ক, হূগলির পোলবা ব্লকের মত্স সম্প্রসারণ বিভাগেও সরবরাহ করছেন স্বল্প মূল্যে। এতে স্থানীয় উপাদানের সদ্ব্যবহার হচ্ছে, কয়েকটি স্থানীয় মানুষজনও এর পরিবহনের সাথে যুক্ত হয়ে কিছুটা আয় করতে পারছেন, মাছ চাষে খরচও কমছে আর গোষ্ঠীর সদস্যদের আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের পরিবারের জীবনেও পূর্ণতা আসছে; অন্তত বাড়িতে আর্থিক অসুবিধেটা আর থাকছে না।
সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে বেশ কিছু মহিলা গোষ্ঠী সামুদ্রিক মাছের প্রক্রিয়াকরণ প্রকল্পে যুক্ত আছেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় শুটকি মাছ প্রস্তুতি করণ, জীবাণুমুক্ত প্যাকেজিং ও সেই সঙ্গে বিপনন। সমগ্র প্রকল্পটির দেখাশোনা করছে নিমপিঠে অবস্থিত বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউট অফ বায়ো-টেকনোলজি, যারা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে, সৌরশক্তির সাহায্যে মাছ শুকনো করে প্যাকেটজাত করে এই মহিলা গোষ্ঠীদের প্রত্যেক বছর শীতের সময় (নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত) এক টানা কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে পারিবারিক আয় বাড়ছে আর স্থানীয় বাজারে এমনকি উত্তরপূর্বাঞ্চলের আটটি রাজ্যতেই উচ্চ মানের শুটকি মাছ fssai-এর শংসাপত্র সহ চমত্কার প্যাকেটজাত অবস্থায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ কম খরচে ভাসমান বাক্সে কাঁকড়া পালন “বক্স ক্রাব টেকনোলজি”
হুগলী জেলার ধনিয়াখালি ব্লকে স্থানীয় সম্প্রসারণ অধিকারিকের সহযোগীতায় একটি বড় মহিলা গোষ্ঠী মাছের আঁশ দিয়ে নানান রকম শৌখিন জিনিসপত্র গহনা ইত্যাদি প্রস্তুত করে চলেছেন। বলা বাহুল্য বাজারে তাদের এই জিনিস পত্রের যথেষ্ট চাহিদাও তারা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। রাজ্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মেলায় এদের উপস্থিতি হয়ত অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায় নি।
সারা দেশের মধ্যে রঙিন মাছের বাজার আমাদের রাজ্যেই সব চেয়ে বেশি আর এই রঙিন মাছের চাষ, পরিপালন, প্রজনন, এদের খাবার এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ, প্রায় সমস্তটাই আমাদের রাজ্যের বিশেষ কয়েকটি ব্লকে যেমন ডায়মন্ড হারবারের কাছে বিষ্ণুপুর ও আমতলা এবং হাওড়ার দাসনগরে সীমাবদ্ধ যার সবটাই মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত। তমলুক ব্লকেও একই রকম চিত্র লক্ষণীয়। রঙিন মাছের চাষ করে স্ব্নির্ভর দল গুলি আজ যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এই সব ব্লকে একের পর এক গ্রাম প্রায় সব পরিবারই রঙিন মাছের চাষ সংক্রান্ত কাজ নিয়ে ব্যস্ত এবং তারা এখান থেকে নিশ্চয় ভাল রোজগারও করছেন।
গতকয়েক বছর ধরে কয়েকটি বিশেষ ফার্মে যেমন পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না, মালদার বড় সাগরদিঘী, দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে, পূর্ব বর্ধমানের কালনায় বড় মাছ উত্পাদন হয়ে চলেছে। শুধু যে রুই, কাতলা উত্পাদন হচ্ছে তাই নয়, সঙ্গে আছে পাঙ্গাস, ভেটকি, গিফট (genetically improved farmed tilapia) তিলাপিয়াও ইত্যাদি। কয়েকটি মহিলা দল তমলুক প্রকল্পের রনসিংঘা ফার্মে প্রশিক্ষিত হয়ে এই সমস্ত বড় মাছ থেকে ফিলে (fillet) তৈরি করে বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরায়, শপিং মলে নিয়মিত সরবরহ করছেন এবং তা কর্পোরেশননের ফুড ইন্সপেকটর দ্বারা নিয়মিত আসেসমেন্ট (assessment) হয়। আগে আমাদের আমদানি করতে হতো, এখন আমরা রপ্তানী করছি অর্থাত্ বিদেশী মুদ্রার আয় হচ্ছে – এটি একটি অভাবনীয় উন্নতি যার মূলে রয়েছে অদ্বিতীয় ভাবে মহিলাদেরই অবদান।
ফলে এই উপরিউক্ত সব ক্ষেত্র গুলির উপর আলোকপাত করে আমরা একথা সহজেই বলতে পারি যে, গ্রামীণ মহিলাদের এগিয়ে চলার পথে মাছ ও মাছ চাষের আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলির উপর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে তাদের স্ব্নির্ভর করে তোলার আমাদের রাজ্যের এই দৃস্টান্ত অন্য যেকোনো রাজ্যের কাছেই অনুকরণীয়।
ঊর্ণা ব্যানার্জী* ও প্রতাপ মুখোপাধ্যায় **
* প্রাক্তনী আলাগাপ্পা বিশ্ববিদ্যালয়, তামিল নাডু
** অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিজ্ঞানী, আইসিএআর – সিআইএফএ (ICAR-CIFA), ভুবনেশ্বর
Share your comments