পোল্ট্রি কথাটির অর্থ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি (যেমন হাঁস, মুরগী, কোয়েল, এমু, টার্কি ইত্যাদি)। ভারতে এই পোল্ট্রি পালনের ৯০% হল মুরগী পালন। কারণ প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের উৎস বলে মুরগীর মাংস ও ডিমের চাহিদা যথেষ্ট বেশী। তবে ইদানিং কোয়েল, টার্কি, এমু ইত্যাদির চাহিদা বেড়েছে। আমাদের দেশে পোল্ট্রি পালন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত এটি গ্রামীণ যুবক যুবতিদের কর্মসংস্থান যোগাতে সহায়তা করে।
উৎপাদন প্রকার - প্রথমে আপনার পোল্ট্রির খামারে কি ধরনের হাঁস ও মুরগী উৎপাদন করবেন, তা নির্ধারণ করতে হবে। আপনি মাংস উত্পাদনের উদ্দেশ্যে ব্রয়লার মুরগী উৎপাদন করতে পারেন এবং আপনি বাণিজ্যিকভাবে ডিম উৎপাদনও করতে পারেন। আপনি সরাসরি আপনার স্থানীয় গ্রাহকদের কাছে পোল্ট্রি পণ্য বিক্রি করতে পারেন। উৎপাদন অনুসারে সঠিক হাঁস-মুরগীর জাত নির্বাচন করুন এবং বিস্তারিত পরিকল্পনা করুন।
খামারের অবস্থান - আপনার ব্যবসার জন্য খামারের সঠিক অবস্থান নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি স্থান নির্বাচন করতে হবে, যেখানে প্রয়োজনীয় সমস্ত সুবিধা আছে এবং ব্যবসার পক্ষে উপযুক্ত। এটি শহর থেকে সামান্য দূরে হতে পারে, যেখানে জমি এবং শ্রম বেশ সস্তা। কিন্তু শহর থেকে খুব দূরে খামারের অবস্থান ঠিক করবেন না, কারণ শহরে জনসংখ্যা বেশী হয়, তাই বিপণনের ক্ষেত্র রূপে শহরের বাজার লক্ষ্য করা যেতে পারে। এছাড়াও আবাসিক এলাকায় খামার স্থাপন এড়িয়ে চলুন, কারণ হাঁস-মুরগীর খামার থেকে দুর্গন্ধ হয়। খামারের অবস্থান নির্বাচন করার সময় পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে খেয়াল রাখা আবশ্যক।
প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম - আপনার পোল্ট্রি খামারের জন্য কিছু সরঞ্জাম ক্রয় করতে হবে। যেমন -
- ফিডার
- বাসা
- খাঁচা
- বাক্স
- ডিম ট্রে
- আলোর যন্ত্র
- হিটার
- বায়ুচলাচল পদ্ধতি
- বর্জ্য নিষ্পত্তি সিস্টেম
ঘর নির্মাণ - খামারের অবস্থান নির্বাচন করার পরে, আপনার হাঁস ও মুরগীর জন্য একটি ভাল ঘর নির্মাণ করতে হবে। নতুন ঘরে সব প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। গড়ে, ব্রয়লার পোল্ট্রির জন্য প্রায় ২.৫ বর্গ ফুট এবং লেয়ার পোল্ট্রির জন্য প্রায় ৪ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি ২০০ টি স্তর চান তবে আপনাকে ৮০০ বর্গ ফুট জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। খাঁচা পদ্ধতিতে প্রত্যেক প্রাণীর জন্য প্রায় ৪ বর্গ ফুট জায়গা প্রয়োজন। খামারে সঠিক পরিমাণে আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
শ্রমিক - মুরগীর সংখ্যার উপর নির্ভর করে, আপনি কম বা কম বা বেশী শ্রমিক নিয়োগ করতে পারেন। একজন শিক্ষানবিশ হিসাবে, আপনি যদি সর্বনিম্ন সংখ্যক মুরগী (২০০-৫০০) দিয়ে শুরু করেন, তবে আপনি নিজের খামার সহজে নিজেই পরিচালনা করতে পারবেন। আপনি যদি বেশী মুরগী উৎপাদন করার পরিকল্পনা করেন, তবে আপনার অতিরিক্ত শ্রমিকের দরকার হবে।
মুরগীর বাচ্চা ক্রয় - সবকিছু প্রস্তুত করার পরে, আপনার এলাকায় বিশ্বস্ত জায়গা থেকে ভালো মানের মুরগীর বাচ্চা কিনুন এবং তাদের যত্ন নেওয়া শুরু করুন। যদি আপনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে বাচ্চাদের সংখ্যা সর্বনিম্নতে রাখুন (৫০০ -এর বেশি নয়)।
প্রতিপালন – সুষম খাদ্য প্রদান হাঁস-মুরগী চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনি বাজার থেকে খাবার কিনতে পারেন অথবা নিজেই খাদ্য প্রস্তুত করতে পারেন।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা - মুরগীদের বিভিন্ন ধরণের রোগের প্রবণতা দেখা যায়। তাদের সর্বদা তাদের তাজা জল এবং খাদ্য দিন এবং সময়মত টিকা প্রদান আবশ্যক।
লগ্নী - পোল্ট্রি চাষের জন্য আপনি নিজের টাকা দিয়ে ব্যবসা করতে পারেন বা আপনি ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন। সরকারী এবং বেসরকারী উভয় ব্যাংক পোল্ট্রি চাষের ব্যবসা শুরু করার জন্য ঋণ প্রদান করে।
মুরগী পালন পদ্ধতি প্রধানত তিন প্রকারের হয়, যেমন –
(১) মুক্তাঙ্গন পদ্ধতি - এই পদ্ধতিতে সাধারণত দেশি মুরগীই চাষ করা হয়। তবে প্রতি মুরগীকে গড়ে ৩৫ -৫০ গ্রাম করে প্রতিদিন সুষম দানা খাদ্য খাওয়ালে ডিমের পরিমাণ বাড়ে। এই খাবার বাজারে কিনতে পাওয়া যায় আবার স্থানীয় ভাবে তুলনামূলকজ কম খরচে বাড়িতেও বানানো যায়, এর জন্য প্রয়োজন –
- খুদ বা গম ভাঙ্গা বা ভুট্টা ভাঙ্গা – ৩২%
- চালের কুড়ো – ২৫%
- সরষের খোল – ৪০%
- খনিজ পদার্থ – ২%
- খাদ্য লবণ – ১%
মোট – ১০০%
এই ১০০ কেজি মিশ্রণের সঙ্গে ভিটামিন (A,B2,D2) ২৫ গ্রাম করে মেশাতে হবে।
(২) অর্ধ-আবৃতাঙ্গন পদ্ধতি – এই পদ্ধতিতে মুরগী স্বাধীনভাবে বিচরণ করলেও একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বাইরে যেতে পারে না। এই পদ্ধতিতে মুরগীর ঘর তৈরী করতে হয় ও ঘর সংলগ্ন কিছুটা জায়গা ঘেরা থাকে যাতে মুরগীগুলি স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে।
(৩) আবৃতাঙ্গন পদ্ধতি, এই পদ্ধতি আবার দুই প্রকারের –
(ক) ডিপলিটার পদ্ধতি
(খ) খাঁচায় মুরগী পালন
ডিম উৎপাদন লাভজনক করতে পোল্ট্রিখামারে মুরগীর বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন। মুরগীর সাথে মোরগের প্রতিপালন সমান গুরুত্বের। পোল্ট্রিমুরগী পালনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত -
- ওজন ১৪০০ - ১৫০০ গ্রাম হলে মুরগী ডিম পাড়তে শুরু করে। লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে মুরগীর দেহের ওজন কোনভাবে ২৫ – ৫০ গ্রামের বেশি না বাড়ে। দেহে ফ্যাট বেশী জমলে পরবর্তীকালে ডিমের পরিমাণ কমে যেতে থাকে।
- মুরগী ও মোরগের অনুপাত ৫ : ১ রাখতে হবে।
- ঘরের মেঝে থেকে ৮ – ১০ ইঞ্চি উপরে প্রতি ৫ – ৬ টি পাখি প্রতি একটি করে ডিম পাড়ার বাক্স রাখতে হবে। ডিম পাড়ার বাক্সে ৩ – ৪ ইঞ্চি পুরু লিটার ব্যবহার করতে হবে যাতে ডিম ভেঙে না যায়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর লিটার পরিবর্তন করতে হবে।
- ডিম পাড়ার সময় প্রাকৃতিক আলো ছাড়াও কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক আলো ও কৃত্তিম আলোর মোট সময় প্রায় ১২ ঘন্টা + ৫ ঘন্টা = ১৭ ঘন্টা হওয়া উচিৎ। ভোর বেলা ও সন্ধ্যের সময় এই কৃত্তিম আলো দিতে হবে।
- মুরগী পালন লাভজনক করতে খাবারের দিকে বিশেষ নজর প্রয়োজন। মুক্তাঙ্গনে ও খামারে পালিত মুরগীকে খাবারের উচ্ছিষ্ট, পোকামাকড়, সবজির খোসা, মুড়ি, চাল, ক্ষুদ - কুঁড়ো, ভাতের মাড় ইত্যাদির সঙ্গে ভিটামিন ও খনিজ লবন মিশিয়ে দিলে ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। মুরগীর খাবারে গেঁড়ি গুগলি থাকলে মুরগীর প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা মেটে ও ডিমের খোসা মোটা হয়, সহজে ভাঙে না ।
- মুরগীকে নিয়মিত সবুজ খাদ্যের সরবরাহ দিলে ভিটামিনের চাহিদা পূরণ হয়।
- খামারের মুরগীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিয়মিত ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন।
- মুরগীর খাবারের পাত্র সপ্তাহে একদিন পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও জলের দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত।
- মুরগীকে সবসময় বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করা উচিত। গরমের সময় অবশ্যই ঠান্ডা বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করা উচিত। জলের সাথে অনেক সময় জীবাণুনাশক মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মুরগীর জলের জায়গা উলটে মেঝে বা লিটার যাতে ভিজে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
মুরগীর কিছু রোগ -
- ব্যাকটেরিয়া রোগ: ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগগুলি ব্যাকটেরিয়া রোগ হিসাবে পরিচিত, যেমন - কলেরা, পুলোরাম ইত্যাদি।
- ছত্রাকের রোগ: এই ধরনের রোগ ছত্রাকের মাধ্যমে হাঁস-মুরগীদের আক্রমণ করে। স্পারজিলিসিস, ফিভাস, থ্র্যাশ, ইত্যাদি।
- পরজীবী রোগ: মাইক্রোপ্লাজোসিস, কোলবিসিলিসিস, স্টেপটোক্যাকিচ, কোকিসিওডিসিস, এস্পিজিলিসিস, ওয়ার্মস ইত্যাদি পরজীবী হাঁস ও মুরগীর রোগ।
ব্রয়লার মুরগীর কিছু ঔষধ –
- ১ দিন – গ্লুকোজ (৫০গ্রাম), ইলেকট্রোলাইট (২০ গ্রাম) ও ডিসট্রেস পাউডার (০.৫)গ্রাম – ১০০ টি পাখির জন্য পানীয় জলে মেশাতে হবে।
- ২-৪ দিন – সকালে জলে ভিটামিন ও বিকেলে জলে অ্যান্টিবায়োটিক।
- ৫-৭ দিন – পানীয় জলে ভিটামিন-A ও ভিটামিন-B কমপ্লেক্স।
- ১২-১৪ দিন - পানীয় জলে ভিটামিন।
- ১৫-২১ দিন – খাদ্য বা পানীয় জলে লিভার টনিক।
- ২৯-৩২ দিন – সকালের জলে ভিটামিন ও বিকেলের জলে বা খাবারে লিভার টনিক।
- ৩৩-৩৫ দিন – জলে বা খাদ্যে লিভার টনিক।
টীকা –
- প্রথম বা দ্বিতীয় দিন – মরেক্স রোগের টীকা।
- ষষ্ঠ বা সপ্তম দিন – রানীক্ষেত রোগের টীকা
- চোদ্দ তম দিন – গামবোর রোগের টীকা।
- একুশ-তেইশ তম দিন – রানীক্ষেত রোগের প্রতিষেধক টীকা।
- আঠাশ তম দিনের মধ্যে – ককসিডিয়া নাশক ঔষধ প্রতিষেধক হিসেবে।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
Share your comments