মাছ কাটার পর ফেলে দেওয়া অবশিষ্টাংশ কিংবা অবাঞ্ছিত মাছ কে উৎকৃষ্ট সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আর এই মাছ-সার, বাগান বাড়ি পরিচর্যার জন্য এক অন্যতম সার হিসেবে কাজ করে। শহরাঞ্চলে অনেকেই বাড়ির ছাদে, উঠোনে বিভিন্ন গাছ-গাছালীর বাগান সাজান। তারা নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারেন এই মাছের সার, যার নাম “মাছ-সার” বা ফিশ ফার্টিলাইজার ।
আমরা সকলেই জানি কৃষিক্ষেত্রের সারের ব্যবহার অতি প্রাচীন। এর মধ্যে মাছের সার একটি জৈব সার। বরং অন্যন্য সারের চেয়ে মাছ-সার অনেকটাই এগিয়ে। রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈব সার অনেক ভালো। রাসায়নিক সার হল সিন্থেটিক যৌগ, রাসায়নিকের সংমিশ্রণ। এদিক থেকে মাছ-সার একটি জৈব সার হিসেবে পরিবেশবান্ধবভাবে কার্যকর, যা মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে পুষ্টি সরবরাহ করে।
এই নিবন্ধে আলোচনা করব, মাছের সার কী, সারের রূপে ব্যবহারের জন্য কি কি ধরণের মাছ ব্যবহার করা যায় এবং সুবিধার পাশাপাশি মাছের সার ব্যবহারের অসুবিধাগুলি। আমরা যারা বাড়ির ছাদে, ব্যালকনিতে বা বাড়িতে বাগান করার শখ আছে, তারা অতি সহজে এই মাছ-সার ব্যাবহার করতে পারেন।
আমরা সকলেই প্রায় জানি যে উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার জন্য নির্দিষ্ট অনুপাতের বিভিন্ন ধরণের খনিজ পুষ্টির প্রয়োজন, তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্যকর মাটির প্রয়োজন। এর মুখ্য উপাদান নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাসিয়াম। উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যের জন্য এই পুষ্টিগুলির সুষম, অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ থাকা অপরিহার্য। এন.পি.কে. (নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাসিয়াম ) এবং অনেকগুলি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস ছাড়াও মাছের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তেল, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন, হরমোন এবং এনজাইম রয়েছে, যা জৈবিকভাবে সক্রিয় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তাই সার হিসেবে মাছ অন্যতম উৎকৃষ্ট।
“মাছ-সার” কথাটি আমরা নতুন শুনছি মনে হতে পারে। কিন্তু এটা কোনো অভিনব পদ্ধতি নয়, বরং ইতিহাস বলে মাছের সারের ব্যবহার অনেকটাই প্রাচীন।
রাসায়নিক সারের তুলনায় মাছের সার বেশি কার্যকরী ও পরিবেশবান্ধব । রাসায়নিক সার সমূহ এমন ভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়, যা বাগানে উদ্ভিদের শোষণের জন্য দ্রুত তাত্ক্ষণিক পুষ্টি সরবরাহ করে বটে কিন্তু দীর্ঘ প্রসারিতভাবে মাটির উর্বরতা রক্ষা করতে পারেনা। মাছের সার মাটিতে ক্রমবর্ধমান মাইক্রোবায়াল ক্রিয়াকলাপের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সহ উদ্ভিদ খাদ্যের তাত্ক্ষণিক উপকার সরবরাহ করে।
মাছের সারগুলি মাটিতে পৃথকভাবে প্রাকৃতিকভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়, কারণ তাদের মধ্যে এমন পুষ্টি থাকে যা জীবাণু, কেঁচো এবং ছত্রাকের মতো জীব দ্বারা পাচিত হয়ে তৈরী হয়। এই সমস্ত মাইক্রোবায়াল ক্রিয়াকলাপ মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়িয়ে গাছের শক্তি এবং জোর বাড়ায়। ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া পুষ্টিগুলি ভেঙে দেয় এবং গাছের বৃদ্ধি ও অন্যন্য জৈব কার্যকলাপে সাহায্য করে।
যেমন মাছের সার মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি করে, তেমনি গাছের সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক পুষ্টি সরবরাহ করে মাটির উর্বরতাও বাড়ায়। ফসফরাস এবং পটাসিয়ামের মতো প্রাথমিক পুষ্টিগুলির সাথে ফিশ সারগুলি মুক্ত নাইট্রোজেনও সরবরাহ করে। মাছের সার অন্যান্য পুষ্টির মধ্যে মানসম্পন্ন নাইট্রোজেন সরবরাহ করে, মাটিতে ভরপুর খনিজ পুষ্টির যোগান দেয়।
প্রাকৃতিক ভাবে বিশেষত নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস উপলভ্য, এগুলি বিশেষত মূল্যবান যখন আপনার মাটিতে এখনও যথেষ্ট পরিমাণে হিউমাস নেই। মাছের সারে শুধু যে এনপিকে - নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাসিয়াম বেশি থাকে তাই নয়, মাছের সারে বাড়তি ক্যালসিয়ামও পাওয়া যায়, যা অনেক কৃত্রিম সারে পাওয়া যায়না। তাই মাছের সারে এই প্রাথমিক ও সেকেন্ডারী পুষ্টিগুলির একটি ভারসাম্য উদ্ভিদগুলির সঠিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং গাছের রোগ ও কীটপতঙ্গ সমস্যা থেকে রক্ষা করে। সমস্ত গাছের উন্নতি করার জন্য উর্বর, জৈবিকভাবে সক্রিয় মাটি প্রয়োজন।
মাছের এই অবশিষ্টাংশ বা অবাঞ্ছিত মাছ গুলোকে ফিশ ফার্টিলাইজার হিসেবে কীভাবে ব্যবহার করবেন ? মাছের সার দুই ভাবে ব্যবহার করা যায়। এক ফিস স্ক্রাব বা মাছের গুঁড়ো, দুই ফিস ইমালসন বা মাছের দ্রবণ।
আবার “ফিশ স্ক্রাব” বা “মাছের গুঁড়ো” সার হিসেবে বাগান পরিচর্যায় ব্যবহার করা হয়। মাছের সার তৈরি করতে এই সব মাছের অংশগুলি পিষে নিতে হবে। এর জন্য রান্নাঘরের ব্লেন্ডারের চেয়ে হ্যান্ড গ্রিন্ডার বা স্টিক ব্লেন্ডার ব্যবহার করলে ভালো। এটি পরিষ্কার করা সহজ। এই মাছের গুঁড়ো বাগানে গাছের নিচে মাটিতে বেশ গভীর করে পুঁতে দিতে হবে। তবে সচেতন থাকুন যে কুকুর এবং কিছু বন্য প্রাণী তীব্র গন্ধের কোনকিছু খুব পছন্দ করে, তাই মাছের গুঁড়ো মাটির ভেতর পুঁতে দিতে হবে। খোলা জায়গায় বেড়া দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
তবে “ফিশ স্ক্রাব” এর থেকে মাছের ইমালশন তৈরি করার চেষ্টা করুন। বাড়ির বাগান পরিচর্যার জন্য মাছের সার হিসেবে “ফিশ ইমালসন বা মাছের দ্রবণ” অতি সহজে বানিয়ে নিতে পারেন। এর জন্য একটি বালতিতে দুইয়ের তিন অংশ মাছের উচ্ছিংশ ভরে ফেলতে হবে। এর সঙ্গে কিছুটা চিটে গুড় মিশিয়ে দিলে খুব ভালো হয়। এরপর ঢাকনা লাগানো পাত্রে প্রায় এক সপ্তাহ রেখে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে সেই পাত্রটি যেন সরাসরি সূর্যের আলোয় না থাকে। এরপর তৈরি হবে মাছের সার। একে অল্প অল্প করে গাছের গোড়ায় গর্ত করে ঢেলে দিয়ে মাটি ঢাকা দিন। আবার প্রায় তিনলিটার জলে এক কাপ তরল মাছের সার মিশিয়ে গাছে স্প্রে করাও যেতে পারে। তবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
আবার কম্পোস্ট সার তৈরিতে মাছের ব্যবহার করলে সারের গুনাগুন অনেকাংশে বেড়ে যায়।
কম্পোস্টের স্তুপে অবাঞ্ছিত মাছ বা অব্যবহৃত মাছের কাঁটা, মাথা ইত্যাদি প্রয়োগ করলে কম্পোস্টে নাইট্রোজেন এবং ট্রেস মিনারেল এর বাড়তি যোগান পায়।
সুতরাং এটা বলা যায় বাগানের সার হিসাবে মাছের উচ্ছিষ্টাংশ মাছ-সার (ফিশ ফার্টিলাইজার) হিসেবে ব্যবহার অত্যন্ত লাভজনক ও পরিবেশ বান্ধব। তাই এর পরের বার নষ্ট হওয়া মাছ বা মাছের দেহ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার আগে, এক সেকেন্ডের জন্য থামুন এবং পুনর্বিবেচনা করবেন।
Image source - Google
Related link - (Organic fertilizer) উদ্ভিদে কীটশত্রুর আক্রমণ? ডিমের খোসা থেকে তৈরি এই জৈব সার প্রয়োগ করে উদ্ভিদকে সহজেই রক্ষা করুন
Share your comments