খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পারস্পরিক পুষ্টির চাহিদা পূরণে মাছের চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিভিন্ন ধরনের মাছের মধ্যে পাঙ্গাস মাছ অন্যতম। বর্তমানে পাঙ্গাস মাছ রপ্তানী যোগ্য মাছ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। আবার পাঙ্গাস মাছের বাহ্যিক চেহারা সুন্দর হওয়ায় “অ্যাকোয়ারিয়াম ফিশ” হিসেবেও পাঙ্গাসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে । অনেক বড় অ্যাকোয়ারিয়ামেও এদের সহজে রাখা যায়। আবার অধুনা এই মাছ স্থানীয় বাজারেও বেশ একটা স্থান করে নিয়েছে। এমনিতেই অনেকের কাছে এই মাছ বেশ পছন্দের— কারণ এই মাছের কাঁটা অনেক কম। এ ছাড়া ছোট–বড় রেস্তোরাঁয় বা একটু বেশি তেল–মশলা সহকারে রন্ধনের জন্য এর চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বোপরি এই মাছের গড় ফলন বা বৃদ্ধি অনেক বেশি; সাধারণ রুই, কাতলা, মৃগেল ফলনের প্রায় ৪/৫ গুণ। তাই ইদানীং অনেক চাষি পাঙ্গাস মাছ চাষে প্রায়শই আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাই জলাশয়ে পরিকল্পিতভাবে পাঙ্গাস মাছের চাষ করলে সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বিপুল সংখ্যক বেকার যুব ও যুবতীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে ।
পাঙ্গাস মাছ স্বল্প নোনা জল এবং মিঠা জলের মাছ। প্রতিকূল পরিবেশ এই মাছ উৎপাদনক্ষম। তাই সহজে যেকোনো পুকুরে চাষ করা যায় এবং নতুন চাষিরাও এই মাছের চাষ শুরু করতে পারেন। পাঙ্গাস মাছের দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে, ফলে রুইজাতীয় মাছ চাষের চেয়ে পাঙ্গাস মাছের চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। সর্বভুক বলে খাদ্যের অপচয় কম, সম্পূরক খাদ্য দিয়ে অন্যান্য মাছের সাথেও চাষ করা যায়। স্বল্প সময়ে (৫-৬ মাসে) বাজারজাত করে মুনাফা অর্জন করা যায়। যদি এই মাছ বাজারে তাজা অবস্থায় বিক্রয় করা যায়, তবে বিক্রি ভালো হয়।
পাঙ্গাস মাছের খাবার প্রয়োগ -
পালন-পুকুরে মাছের চারা ছাড়ার ২ / ১ দিন পর থেকে পরিপূরক খাবার দিতে হয়। প্রথম ৭ / ১০ দিন পর্যন্ত মাছের মোট ওজনের শতকরা ৩ ভাগ খাবার সকাল ৬ টা থেকে ৮ টার মধ্যে দিতে হয়। সারা দিনে এই সময় খাবার দেওয়া হয় এক বারই।
এর পর ৭ / ১০ দিন বাদ থেকে খাবারের পরিমাণ বাড়ানো হয় -- ওজনের শতকরা ৫ – ৮ ভাগ পর্যন্ত খাবার প্রয়োগ করা হয়। এই খাবার আস্তে আস্তে ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হয়। এদের ৯০ – ৯৫ দিন বয়স পর্যন্ত এই হারেই খাবার দেওয়া হয়। এর পর মাছের গায়ে চর্বি আসা অবধি এই বৃদ্ধি চলে।
মেঘলা হলে বা মাছ ঠিকমতো সব খাবার না খেলে খাবার দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। তাই সব সময় দৃষ্টি রাখতে হবে কোনও রকম অস্বাভাবিক আচরণ বা গতিবিধি মাছের হচ্ছে কি না।
পরিমিত খাবার - ভাসমান খাবারই এদের খুব পছন্দ এবং এই খাবারই এরা খায়। সব থেকে ভালো খাবার পরীক্ষিত ভাসমান খাবার (বাজারে পাওয়া যায় ১ : ৩ : ১)।
মাছের ওজন ৪০০ – ৫০০ গ্রাম হলে বা চর্বি জমতে শুরু করলে বা ২ – ৩ মাস বয়সের পর থেকে সকালের খাবারে মটর সিদ্ধ (৬০%) ও বিকেলের খাবারে অল্প বাদাম খোল (৪০%) মিশিয়ে দিলে ভালো হয়।
উন্নত উপায়ে অর্থাৎ ভালো জলে, সঠিক পরিচর্যা করে, উপযুক্ত ও সঠিক খাবার প্রয়োগ করলে মাছের গুণমান অনেক বেড়ে যায়। এদের গায়ের রং, মাংসের রং, স্বাদ ও গন্ধ ভালো হয়।
জৈব জুস প্রয়োগ করলে মাছের উৎপাদন আরো ভালো পাওয়া সম্ভব। জৈব জুসে উপস্থিত কার্বন জলের অ্যামোনিয়া সহ ক্ষতিকারক গ্যাস দূর করে দেয় , উপকারী ব্যাক্টেরিয়া বা বন্ধু জীবাণু জলের তলার জৈব পদার্থকে মাছের খাবারে পরিণত করে। কিভাবে এই জুস তৈরি করতে হবে? ২৫ ডেসিমেল পুকুরের জন্য আড়াই কেজি বাদাম খোল, তিন কেজি চালের গুঁড়ো, ছয়শো গ্রাম ঈষ্ট পাউডার, তিন কেজি চিটে গুড় , দেড় কেজি আটা, তিনশো গ্রাম কলা ও দেড় কেজি যেকোনো পোনা মাছের খাবার একসাথে তিন গুণ জলের সাথে মিশিয়ে তিন দিন পচিয়ে পুকুরে দিতে হবে। মাসে দুবার করে জৈব জুস প্রয়োগ করা দরকার। জুস প্রয়োগের আগে চুন দেওয়া আবশ্যক।
ফসল তোলা বা মাছ ধরা -
মাছ তোলা এবং বাজারজাত করার সময় ও পদ্ধতির উপর মাছ চাষের লাভক্ষতি অনেক অংশেই নির্ভর করে। তাই পাঙ্গাস মাছ ধরার জন্য কয়েকটি কথা মনে রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী ও বাজারের চাহিদার গুরুত্ব দিয়ে মাছ ধরতে হবে।
পাঙ্গাস মাছের স্থানীয় বাজারের চাহিদা যতক্ষণ মাছ জীবিত থাকে। মরা মাছের দাম অর্ধেক হয়ে যায়।
বছরে সাধারণত ৩ বার মাছ ধরা হয়।
স্থানীয় বাজারে ছোট (৪০০ – ১০০০ গ্রাম ) মাছের চাহিদা বেশি ।
এই মাছ প্রথম ৩ – ৪ মাস ভীষণ বাড়ে। যদি মাছের সংখ্যা কমানোর প্রয়োজন না থাকে, তবে মাছ ধরা স্থগিত রেখে মাছকে বাড়তে দিলে বেশি লাভ হয়।
গ্রীষ্মে এই মাছ বেশি বাড়ে। বৈশাখের শেষে বা জ্যৈষ্ঠ মাসে এদের ওজন ৭০০ গ্রামের ঊর্ধ্বে হয়ে যায়। এই সময় সমস্ত মাছ ধরে বাজারজাত করে নতুন ভাবে আবার বছর-ফেরি চারা মাছ (১৫ গ্রাম) জ্যৈষ্ঠ মাসে ছাড়লে, শ্রাবণের শেষে ৭০০ গ্রামের ঊর্ধ্বে ওজনের মাছ আবার তৈরি হয়ে যাবে।
শ্রাবণ মাসের শেষে দ্বিতীয় বার ফসল বিক্রি করে একই ভাবে তৃতীয় চাষ আরম্ভ করা যায়। এর পর পরিবেশ ঠান্ডা হতে থাকে, মাছের বৃদ্ধি ভালো হয় না।
তৃতীয় বারের মাছ যে হেতু শীতে বেশি বাড়বে না তাই আশ্বিনের শেষে ৩০০ – ৪০০ গ্রাম ওজনের মাছের শতকরা ৬০ – ৭০ ভাগ ধরে বাজারজাত করতে হবে। ওই স্থানে শতকরা ২৫ – ৩০ ভাগ পাঙ্গাসের চারার সঙ্গে বিঘা প্রতি ৬০০ – ৭০০ টি (৪০০০ – ৫০০০ প্রতি হেক্টরে) রুই, কাতলা (মৃগেল নয়) ছাড়া যেতে পারে।
ফাল্গুন মাসে গড়ে ৫০০ – ৬০০ গ্রাম হলে বিক্রয় করতে হবে। বড় মাছের স্বাদ বেড়ে যায়।
অনেকের বড় মাছ পছন্দ। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী এদের বাড়তে দেওয়া যেতে পারে।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
তথ্যসূত্র - সুমন কুমার সাহু
Share your comments