ডঃ প্রতাপ কুমার মুখোপাধ্যায়,সৃজনী পতি ও অভিষেক গিরিঃমাছ চাষ অন্যান্য চাষের মতই একটি লাভজনক চাষ। মাছ যে জলজ পরিবেষে থাকে, সেই জলজ পরিবেশে বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন হতে পারে এবং যার জন্য মাছের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এমন পরিবেশে থাকলে মাছের দেহে বিভিন্ন রকম অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা যায় এবং মাছ তার জীবনযাত্রায় বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়। এর ফলে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও মাছ সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
রোগ বলতে কোনো জীবের দেহ ও মনের অস্বাভাবিক অবস্থা কে বোঝায়, যা বিভিন্ন রকমের চিহ্ন, লক্ষণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
আমাদের দেশে জনসংখ্যা যেমন পর পর বাড়ছে, তেমনি মাছের চাহিদাও বাড়ছে। আর সেই চাহিদা পূরন করার জন্য মাছ চাষের প্রবনতাও বাড়ছে, এটা ভালো দিক কিন্তু এই মাছ চাষে যে রোগ সঙ্ক্রমন হয়, তা সঠিক ভাবে নির্ধারণ করে তার প্রতিকার না করতে পারলে, মাছ চাষিরা অনেক সমস্যার মধ্যে পড়বেন।
বর্তমান মাছ চাষে মাছের উকুন বা আরগুলাস মাছ চাষি ভাইদের কাছে একটি মাথা ব্যাথার কারন। এই পরজীবীর আক্রমনের ফলে মাছের বৃদ্ধি ঠিক মতো হচ্ছে না, আবার কোনো কোনো সময় মাছের মৃত্যুও হচ্ছে যার জন্য মাছ চাষি ভাইরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। এর হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা টেকনিসিয়ানের সাহায্য নিচ্ছেন এবং ওখানেই চাষিরা আরও সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, তাঁরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন, যা ব্যাবহারের ফলে লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না।
যখন কোন রোগ জীবাণু বা পরজীবী তার অনুলুল পরিবেশে মাছের দেহে প্রবেশ করে বা শরীরের বাইরে বাসা বাঁধে, তখন মাছের সংক্রামন নীচের যে কোনো একটি অবস্থার মতো হতে পারে -
১. মাছের যে দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে তা রোগ সংক্রামনকে বাধা দেয় এবং রোগ জীবানু কে ধ্বংস করে দেয়, ফলে মাছ সুস্থ্য থাকে।
আরও পড়ুনঃ থাই সরপুঁটির চাষ করবেন? শিখে নিন সহজ পদ্ধতি, লাভ হবে দ্বিগুন
২. মাছের যে দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে তা রোগ সংক্রামনকে বাধা দেয় কিন্তু রোগ জীবানু কে ধ্বংস করতে পারে না, ফলে মাছ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ৩. রোগ জীবাণু বা পরজীবী মাছের দেহে প্রবেশ করে ও প্রতিরোধ ব্যাবস্থা ভেঙ্গে ফেলে, ফলে মাছ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
রোগের নাম: মাছের উকুন (আরগুলাস) ও নোঙর যুক্ত পোকা (লারনিয়া)। এরা সন্ধিপদী পরজীবী।
আক্রান্ত মাছের নামঃ রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ইত্যাদি। সাধারনত মিষ্টি জলের মাছেদের এই রোগে আক্রান্ত হবার প্রবনতা বেশী।
এ জাতীয় পরজীবী মাছের পোনা, অঙ্গুলি পোনা ও বড় মাছ সব ধরনের মাছেরই ক্ষতি করে। নার্সারি পুকুর, লালন পুকুর ও মজুত পুকুরে এই জাতীয় পরজীবীর আক্রমন ঘটে। খোলোসজাতীয় সন্ধিপদ পরজীবীর মধ্যে দুটি পরজীবী মাছের উকুন রোগের জন্য দায়ী। সেগুলি হল-
অ) লারনিয়াসিস (Lernaesis) এবং আ) আরগুলোসিস (Argulosis)
লারনিয়াসিস (Lernaesis) : এই রোগ আংটা কৃমি নামেও পরিচিত। লারনিয়া গনের কয়েকটি প্রজাতি এই রোগ সৃষ্টি করে, যেমন- লারনিয়া পলিমরফা (Lernaea polimorpha), লারনিয়া সিপ্রিনাসিয়া (Lernea Cyprinacea), লারনিয়া টিনোফারিংগোডন্টিস(Lernaea Ctenopharyngodontis)।
আরগুলোসিস (Argulosis): আরগুনাস গনের কয়েকটি প্রজাতি এই রোগ সৃষ্টি করে। যেমন- আরগুলাস ফলি এসিয়াস (Argulus folieaceus), আরগুলাস করিগনি (Argulus coregoni) ।
কেন হয় এই রোগ?
পুকুরের পরিবেশ খারাপ হলে ও পুকুরে পচা কাদা বেশি থাকলে এই পরজীবীর আক্রমন ও সংক্রমণ বেশি ঘটে।
এই রোগের লক্ষনঃ
১. এই রোগের সংক্রমণ হলে মাছ ছোটাছুটি করতে শুরু করে দেয়।
২. মাছের আক্রান্ত স্থানে ফুলে যায়।
৩. মাছের খাদ্য গ্রহনের হার কমে যায় ও মাছ রোগা হয়।
৪. আক্রান্ত স্থান লাল হয়ে যায় ও ঘা হয়।
৫. মাছ এই পরজীবীর হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন শক্ত জায়গায় গা ঘসতে থাকে
৬. মাছের গায়ে পরজীবী আটকে থাকে, যা চ্যাপ্টা পোকার মতো দেখতে মাছের শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে।
প্রতিকারের উপায়ঃ
১.প্রথমের দিকে প্রতি লিটার জলে ৩০ গ্রাম লবন মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। এই ভাবে ৪-৫ দিন করতে হবে।
২. বিঘা প্রতি জলে প্রতি মিটার গভীরতায় ৭৮০ গ্রাম গ্যামাক্সিন প্রয়োগ করে পুকুর শোধন করতে হবে, সপ্তাহে ২ বার।
৩. বিঘা প্রতি জ্বলে ২০ এম এল সাইপারমেথ্রিডিন সূর্যালোকের উপস্থিতিতে দিতে হবে।
৪. পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বিঘা প্রতি ২.৫ কেজি হারে জলে গুলে দিলে উকুন মাছের দেহ থেকে ছেড়ে যায়।
আরও পড়ুনঃ Profitable Fish Farming: মাছ চাষের অভিনব পদ্ধতি,শিখে নিলে লাভ হবে দ্বিগুন
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, এই রোগের জন্য দরকারী ওষুধ বা জৈবিক ভাবে দমন করার পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি এবং এর জন্য আমাদের মৎসা বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু চাষি ভাইদের কাছে কোন উপায় না থাকার জন্য নিরুপায় হয়ে তাঁরা এই সমস্ত রাসায়নিক জিনিস ব্যাবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন, কারন তাদের কাছে তখন ফসল বাঁচানোটাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
তবে বিজ্ঞান যেভাবে এগোচ্ছে এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলস্বরুপ শীঘ্রই আমরা এই পরজীবী জাতীয় রোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য সঠিক পথ খুঁজে পাবো ।
Share your comments