শিঙি মাছ এমনই একটি মাছ যা রোগীদের পথ্য হিসেবে বিবেচিত। মাছের বাজারেও এই মাছের চাহিদা প্রচুর। শিঙি মাছ যেমন স্বাস্থ্যসম্মত তেমনই খেতে স্বাদু। দিনকে দিন শিঙি মাছের চাহিদা বাজারে বাড়ছে, তারসঙ্গে বাড়ছে এই মাছ চাষের প্রথাও। খুব কম খরচে ডোবা বা ছোট ছোট পুকুরে এই মাছের চাষ করা যায়। সামান্য খাবার পেলেই শিঙি মাছ বংশবৃদ্ধি করতে পারে। প্রতিকূল অবস্থাতেও এই মাছ সহজেই বেঁচে থাকতে পারে। সবদিক থেকেই এই মাছ চাষের সুবিধা থাকায় মৎস্য চাষিরা বর্তমানে এই মাছ বিপুল পরিমাণে চাষ করছেন। এই মাছ চাষ করে আর্থিক ভাবে কৃষকরা আর্থিক ভাবে অনেক বেশি লাভবান হওয়াতে, নতুন মাছ চাষিরাও শিঙি মাছ চাষে আগ্রহ পাচ্ছেন।
পুকুর প্রস্তুতি (Pond Preaparation)
এই মাছ চাষে পুকুর প্রস্তুতিতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের পুকুরে শিঙি চাষ অধিক উপযোগী,তবে এক একরের পুকুরেও চাষ করা যায়। প্রথমে পুকুরের জল সেচ দিয়ে শুকিয়ে পুকুরের তলদেশে রোদ লাগাতে পারলে ভালো হয়। অবাঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ পুকুর থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পুকুর প্রস্তুতির প্রাথমিক কাজ শুরু করা উচিত। চুন প্রয়োগ হয়ে গেলে, প্রতি শতাংশে পাঁচ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম টিএসপি এক সঙ্গে গুলে প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পাঁচ থেকে ছয় দিন পর শিঙি মাছের ২ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি সাইজের পোনা মজুদ করতে হবে।
পোনার পরিমাণ (Quantity)
একক চাষে শিঙি মাছ প্রতি শতাংশে ৫০০ থেকে ১ হাজার পোনা ছাড়তে হবে। এক্ষেত্রে পোনা ছাড়ার আগে এবং পরে পুকুরের জলের গুণাগুণ রক্ষা করতে হবে। জল পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলে পোনা কম ছাড়া ভালো। মিশ্র চাষে মাগুর এবং কৈ মাছের সঙ্গেও শিঙি মাছের চাষও ভালো হয়।
উপযুক্ত খাবার (Food)
শিঙি মাছ চাষের জন্য অধিক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার দেওয়া ভালো। লাভজনক চাষে মানসম্মত সম্পূরক খাবার (কমপক্ষে ৩২ ভাগ প্রোটিনসমৃদ্ধ) অপরিহার্য। এক্ষেত্রে কারখানায় প্রস্তুতি মানসম্মত খাবার উত্তম,তবে মানসম্মত ভাসমান খাবার প্রয়োগেরও শিঙি চাষ করা যায়। এক্ষেত্রে পুকুরের তলদেশের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষা করা যায়।
চাষের মেয়াদকাল
মানসম্মত পোনা,সুষম খাবার এবং আদর্শ চাষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে ছয় থেকে সাত মাসে প্রতিটি শিঙি মাছ ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম হয়ে থাকে। এ সময়ের মধ্যে নিয়মিত জলের গুণাগুণ আদর্শমাত্রায় রক্ষা করা গেলে আরও ভালো ফল আশা করা যায়।
আরও পড়ুন: Disease prevention in shrimp farming: চিংড়ি চাষের রোগদমন ও সহজ প্রতিকার ব্যবস্থা
চাষের আদর্শ সময় (Farming Time)
শিঙি মাছের চাষ এপ্রিল-মে মাস থেকে শুরু করা যায়। প্রত্যেক বছর মে-জুন থেকে পোনাপ্রাপ্তির সুবিধা হয়।
চাষ পরিচর্যা (Caring)
শিঙি মাছের চাষে মাছের পরিচর্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই মাছ চাষে অধিক জলের দরকার পড়ে না। পোনা নার্সিংয়ের সময় ২ থেকে ২.৫ ফুট জলই যথেষ্ট,পরে ৩ থেকে ৩.৫ ফুট জলে শিঙি মাছ চাষ করা যায়। পোনা ছাড়ার পর নিয়মিত ও পরিমিত খাবার দিতে হবে। মোট খাবারকে দুই থেকে তিনবারে ভাগ করে দেয়া ভালো। হ্যাচারি থেকে নেওয়া ছোট পোনা সরাসরি চাষে না দিয়ে আলাদা নার্সিং করে ২ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি হলে চাষ পুকুরে দেওয়া উত্তম। পুকুরের জলেরর গুণাগুণ এবং তলদেশের পরিবেশের উপর শিঙি মাছের বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই জলেরর গুণাগুণ রক্ষা করা আবশ্যক।
কখনও কখনও পোনার ত্বক ও ঠোঁটে তুলার মতো সাদা দাগ দেখা দিতে পারে। সেপ্রোলেগনিয়া নামক ছত্রাকের জন্য এমনটি হয়। এক্ষেত্রে প্রতি একরে প্রতি ৩ ফুট জলের জন্য ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিলিটার ‘পলগার্ড প্লাস’ পরপর দুই দিন দুই ডোজ ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যাবে। তাছাড়া ফরমালিন বা ম্যালাকাইট গ্রিনের মাধ্যমেও চিকিৎসা করা যায়।
পরজীবী বা প্রোটোজোয়া কর্তৃক শিঙি মাছ আক্রান্ত হলে ডেলেটিঙ্ প্রয়োগে চমৎকার সুফল পাওয়া যায়। বেশি খাবার প্রয়োগ বা জৈব পদার্থের পচনের মাধ্যমে জলে অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, এ অবস্থায় মাছ মারা যেতে পারে খুব দ্রুত। এ সমস্যা দূরীকরণে প্রতি একরে ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম গ্যাসোনেঙ্ প্লাস সারা পুকুরে (বালির সঙ্গে মিশিয়ে) ছিটিয়ে দিলে তাৎক্ষণিক সুফল পাওয়া যায়। একই সঙ্গে জল পরিবর্তন করে দিতে পারলে ভালো হয়। মূলত অ্যামোনিয়াজনিত সমস্যাই শিঙি মাছের চাষে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
মানসম্মত খাবার ছাড়া শিঙি চাষ লাভবান হয় না। প্রাণিজ প্রোটিন হিসেবে ভালো মানের ফিশমিল ব্যবহার করা আবশ্যক। খাবারের সঙ্গে দ্রুত হজমের জন্য ‘বায়োজাইম’এবং গ্রোথ প্রোমোটর প্রয়োগ করলে অত্যন্ত ভালো ফল পাওয়া যায়।
শিঙি মাছের পুকুরের মধ্যে বা একপাশে বাঁশের বেষ্টনীর মধ্যে কিছু কচুরিপানা রাখা গেলে জলের পরিবেশ এবং শিঙি মাছের জন্য উপযোগী হয়।
আরও পড়ুন: Mixed Fish farming: জেনে নিন পুকুরে একইসাথে মলা ও তেলাপিয়া মাছের চাষ পদ্ধতি
Share your comments