আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক এবং পুষ্টিগত অবস্থা উন্নয়ণের সহায়ক হিসাবে গরু, ছাগল ও মহিষের পরেই ভেড়া পালনের স্থান। ভেড়ার মাংসের পুষ্টিমান এবং স্বাদ ছাগলের মাংসের মতোই। ভেড়ার মাংসে বিরক্তিকর গন্ধও নেই। এ ছাড়া গরুর সাথে একই খামারে বা ঘরে ছাগল পালন করা যায় না কিন্তু অতি সামান্য খরচ ও সহজ পরিচর্যায় গরুর সাথে ভেড়া পালন করা যায়। চর এলাকার বাথান কিংবা যে কোন চারণ ভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত কাঁচা ঘাস খাইয়ে অল্প খরচে বৎসরের শুকনা মৌসুমে প্রায় সব সময়ই ভেড়া পালন করা যায়। ভেড়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভেড়া দলবদ্ধ অবস্থায় গরুর সাথে অবস্থান করতে পছন্দ করে বলে ভেড়া পালনের জন্য তেমন কোন অতিরিক্ত জনবলের প্রয়োজন হয় না।
ভেড়া পালনের নাবা উপকারিতা -
- ভেড়া থেকে একই সাথে মাংস, দুধ ও পশম পাওয়া যায়।
- ভেড়ার জন্য আলাদা উন্নত বাসস্থানের প্রয়োজন হয় না। গরু ও ছাগলের মত একই সাথে পালন করা যায়।ভেড়া নিজেদের খাদ্য নিজেরাই যোগাড় করতে পারে। ভেড়া পালনে প্রাথমিক খরচ তুলনামূলক অনেক কম।ভেড়ার সংখ্যা অতি তাড়াতাড়ি বাড়ে, ভেড়ার মলমূত্র জমির সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়, জমির আগাছা খেয়ে উপকার করে, জলাশয়ের ঘাস চরে খেতে পারে এবং ভেড়ার রোগ-ব্যাধি কম হয়।
- ভেড়া দলবদ্ধ হয়ে বসবাস ও বিচরণ করে, চুরি হওয়ার সম্ভাবনা কম, চড়ানোর জন্য বাড়তি কর্মীর প্রয়োজন নেই, অপেক্ষাকৃত কম খেয়ে অধিক মাংস ও পশম উৎপাদন করে।
ভেড়া তার নরম মুখ দিয়ে অতি ছোট ছোট ঘাস লতাপাতা খেয়ে কৃষি জমির আগাছা কমাতে পারে।
- প্রতি বছরে প্রতিটি ভেড়া ৩.৫-৫.৫ কেজি পশম উৎপাদন করতে পারে।
- ভেড়ার শরীরে অনেক সময় যে ময়লা লাগে তা পরিষ্কার করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়।
- ভেড়া পালন খুবই সম্ভাবনাময় কারণ ভেড়া পালনে অতিরিক্ত তেমন কোন খরচ নেই। সামান্য যত্নে অতি তাড়াতাড়ি ভেড়া বংশ বিস্তার করে এবং দিনের বেলায় ফসলের খালি ক্ষেতে, রাস্তার ধারে ও ফলের বাগানে ছেড়ে বা বেধে পালন করা যায়।
- চাউলের সামান্য কুঁড়া, চাল-ভাজা বা ভাতের মাড় ভেড়াকে খাওয়ানো যেতে পারে।
- একজন খামারী ৩-৬টি ভেড়া পালন করতে পারে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে ১০৬ কোটিরও বেশি ভেড়া আছে। আঞ্চলিক আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং স্বল্প খরচে ও সহজ-প্রাপ্য খাদ্যসাম্গ্রীর উপর ভেড়া পালন নির্ভরশীল। সম্পূর্ণ ছেড়ে খাওয়ানো, সম্পূর্ণ আবদ্ধ অথবা মিশ্র পদ্ধতিতে ভেড়া পালন করা যেতে পারে। চারণ-ভূমিভিত্তিক এবং ভূমিহীন উৎপাদন ব্যবস্থায় ভেড়া পালন করা হয়। এ অবস্থায় খাদ্যর মূল উৎস্ চারণ-ভুমি। মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকাসহ উন্নত প্রায় সব দেশেই চারণ-ভূমিতে ভেড়া পলন করা হয়। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভেড়া চারণ-ভূমিতে পালিত হয়। কৃষি-উপজাত খাদ্য সামগ্রী যথা খড়, ভূষি ও কৃষি খামারের আগাছা সঠিকভাবে ব্যবহার করে পরিবেশ-বান্ধব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গ-রাজ্যসমূহের অনুসরণে ভেড়া পালন করা হচ্ছে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর আমেরিকায় সম্পূর্ণ আবদ্ধ রেখে ভূমিহীন অবস্থায ভেড়া পালন করা হয়। উন্নত দেশে তাজা কাঁচা ঘাস, সংরক্ষিত ঘাস, শুকণা ঘাস এবং দানাদার খাদ্য খাওয়ানো হয় যে কারণে অধিকাংশ সময়ই ভেড়া পালন ব্যয়বহুল হয়।
আমাদের দেশে আধা-নিবিড় সাবসিস্টেন্স পদ্ধতি, সম্পূর্ণ-ছেড়ে পালন, ক্ষুদ্র খামার পদ্ধতি এবং বরেন্দ্র এলাকার আধা-নিবিড় বানিজ্যিক পদ্ধতিতে ভেড়া পালন করা যায়।
অর্থাৎ খামারিগণ গরু-ছাগলের সাথে মিশ্রভাবে ৩-৬টি ভেড়া পালন করেন। ভেড়া রাতের বেলা আলাদা ঘরে থাকে অথবা গরুর সাথে থাকে, দিনের বেলায় ফসলের খালি মাঠে, রাস্তার ধারে, ফলের বাগানে, ছেড়ে বা বেধে পালন করা হয়। এই সমস্ত ভেড়াদের সকালে বা সন্ধ্যায় কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য কুঁড়া, ভূষি, চাল-ভাঙ্গা বা ভাতের মাড় দেয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সবুজ খাবারের প্রাপ্তির বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।
স্হানীয় ভেড়া সাধারণত ১২-১৫ মাস পরপর বাচ্চা দেয় এবং প্রতিটি ভেড়া প্রতিবারে ১-৩টি বাচ্চা দেয়। বর্ষাকালে বাচ্চার মৃত্যুর হার বেশি এবং শুকনা মৌসুমে কম থাকে। বয়স্ক ভেড়ার মৃত্যুর হার খুবই কম কারণ ভেড়ার রোগ-বালাই তেমন দেখা যায় না।
ছোট নাগপুরী জাতের ভেড়ার সাথে দেশী ভেড়ার শংকরায়ণ করে ভেড়া পালন করা হয়। দেশী ভেড়ার ২-৩টি বাচ্চার তুলনায় শংকর জাতের ভেড়া ১-২টি বাচ্চা কম দেয় তবে শংকর জাতের ভেড়া আকারে বড় এবং ওজনে বেশি হয়। শংকর জাতের ভেড়া রোগ-ব্যাধি বেশি হতে পারে এবং গর্ভপাত হতে পারে।
সাধারণত বছরে ২-৩ বার পশম কাটা হয়। শঙ্কর জাতীয় ভেড়ার উৎপাদনের মৌলিক যোগ্যতা সাধারণ বাংলাদেশী ভেড়ার তুলনায় কম। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মাত্রায় কাঁচা ঘাস, খড়, সামান্য আমিষ-সমৃদ্ধ দানাদার খাদ্য, নিয়মিত কৃমিনাশক এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাসস্হানের ব্যবস্হা করতে হবে।
কিছুটা স্বচ্ছল খামারীগণ আধা নিবিড় পদ্ধতিতে ভেড়া পালন করেন। এ ধরণের খামারে সময়ভেদে ৫০-১৫০টি ভেড়া পালা হয় এবং আলাদা আধা-স্হায়ী বা গরুর গোয়ালে রাতের বেলায় ভেড়া রাখা হয়। ঘরের বাইরে বাঁশের ঘেরা এলাকায় সকালে ও বিকালে ভেড়াকে রাখা হয়।
- দেশী ভেড়ার তুলনায় একই বয়সের (৬ মাস) শংকর জাতের ভেড়া থেকে প্রায় দ্বিগুণ মাংস পাওয়া যায়।
ভেড়ার রোগ ও প্রতিকারের উপায়
সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা, পরজীবি, অপুষ্টি, বংশগত অস্বাভাবিকতা, বিপাকীয় সমস্যা এবং বিষাক্ত পদার্থের কারণে ভেড়া রোগাক্রান্ত হতে পারে। • স্ট্রাক, এন্টেরোটক্সিমিয়া বা পাল্পি, কিডনী ডিজিজ, ব্রাক্সি, ব্লাক ডিজিজ, ভেড়ার বাচ্চার আমাশয় ও ওলান পাকা বা ম্যাসটাইটিস, নিউমোনিয়া, ভিবরিওসিস, ব্রুসেলোসিস, ধনুষ্টংকার, ফুটরট, সালমোনেলোসিস, বর্ডার ডিজিজ, বসন্ত, প্লেগ বা পিপিআর, ক্ষুরা রোগ, একযাইমা, কক্সিডিওসিস, টক্সোপ্লাসমোসিস, কলিজা কৃমি, হিমোনকোসিস মেনুজ, উঁকুন, আঁঠালী, প্রেগনেন্সি টক্সিমিয়া, নিয়োনেটাল হাইপোগ্লাইসেমিয়া ইত্যাদি রোগ ভেড়ার হতে পারে। ভেড়ার সকল রোগের সাধারণ লক্ষণগুলি হল - ভেড়ার খাদ্য গ্রহণ ও চলাফেরায় অনীহা দেখা দেবে এবং দল থেকে আলাদা থাকবে।
রোগ-প্রতিরোধে, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ভাল জাতের ভেড়া পালন, খামারসহ সকল পর্যায়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, টিকা প্রদান, সুষম ও নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহ, জৈব-নিরাপত্তাসহ সম্ভাব্য সকল বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা, রোগ সম্পর্কে খামারীকে ধারণা নিতে হবে এবং সর্বোপরি অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।
তথ্য : সংগ্রিহীত
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)
Share your comments