প্রথম পর্বের পর
প্রথমত, একটি ছোট জায়গায় মাত্রাতিরিক্ত চিংড়ির চারা মজুত করার ফলে, বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের নিজেদের মধ্যে ব্যাবধান অনেক কমে যায়, ফলে শুরু হয় সাফোকেশন অর্থাৎ একটি বন্ধ কামরায় একসাথে ৫০ জনকে রাখা হলে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস এর যে ব্যাঘাত ঘটবে এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। সেখানে প্রতিনিয়ত খাওয়ারের জন্য লড়াই করা থেকে শুরু করে রীতিমত স্ট্রেস এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয় মাছেদের। তাই যেটুকু খাওয়ার খাচ্ছে সেটাও ঠিকমত পরিপাক করতে পারছেন না। তাহলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কী করে বজায় থাকবে!
আর সমস্ত রোগ যে এক তা কিন্তু নয়, যে ট্রিটমেন্ট করলেই সেরে উঠবে। কিছু কিছু ভাইরাস ঘটিত রোগ আছে যেগুলো ধরা মানেই মাছের রানিং মরটালিটি শুরু অর্থাৎ কিছু দিনের মধ্যেই মাছ মারা যেতে শুরু করে। সেখানে আর কিছুই করার থাকে না। ফলে অতিরিক্ত লাভের আশা তো ছেড়েই দাও, পরিবর্তে লোকসানের পরিমান বেড়ে যায়। এবার সেক্ষেত্রে ‘স্পিসিস’ অর্থাৎ ‘ভেনামি’ কে দায়ী করলেই তো চলে না। কথায় আছে ‘Prevention is better than cure’। তাই পরে হা-হুতাশ করার চাইতে, প্রথম থেকেই কালচারের প্রতি চাষিকে যথেষ্ট সচেতন এবং যত্নবান হতে হবে।
আরও পড়ুনঃ ভেনামির সারকথা-পর্ব এক
আমরা বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলে থাকি BMPs ( Better Management Practices ) অর্থাৎ ভালভাবে পরিচালনা করা। মাছকে নিয়মিত খাওয়ার দেওয়া থেকে শুরু করে ঠিক সময়ে এয়ারেশন চালানো , মাছ ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা সেদিকে নজর দেওয়া, সাথে প্রতি সপ্তাহে ‘স্যামপ্লিং’ করা অর্থাৎ মাছের গ্রোথ এবং ওয়েট চেক করা, যাতে করে মাছের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তা দেখা। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কালচার চলাকালীন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এই সমস্ত কিছুই BMPs এর অন্তর্গত, তার জন্য চাষীকে যথেষ্ট দক্ষ হতে হবে।
তাই সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভেনামির চাষ করলে লোকসানের সম্ভবনা অনেক কম। আর এবিষয়ে কথা উঠলে সবচেয়ে প্রথমে যেটা করা দরকার তা হল ‘সাইট সিলেকশান’ যার আক্ষরিক অর্থ হল ’স্থান নির্বাচন’ বা ‘জায়গা নির্বাচন’। মাছ চাষের ক্ষেত্রে, সেটা ‘ভেনামি’ চিংড়ি হোক বা অন্য যে কোনো ‘প্রজাতি’ , সর্বপ্রথম নির্দিষ্ট কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ভূমি, জল এবং মাটি। এই তিনটেই হল ‘সাইট সিলেকশনে’র প্রধান ধাপ। ভূমি, অর্থাৎ যেই জমিতে চাষ করবো তার ঢাল কেমন, এবং তা কোন দিকে। জল, অর্থাৎ কালচার পুকুরে নিয়মিত জলের সরবরাহ এবং তা পরিস্কার কিনা।
মাটি, অর্থাৎ সেখানে কাদার ভাগ কতটা এবং তা জল ধরে রাখার উপযোগী কিনা! এছাড়াও ট্রান্সপোর্ট ব্যাবস্থা কতটা স্বচ্ছল, ইলেকট্রিক সাপ্লাই রয়েছে কিনা, কালচার সেক্টর থেকে বাজারের দূরত্ব কত, এসব কিছুই ‘সাইট সিলেকশনে’র অন্তর্গত।
উপরিউক্ত কালচার সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য চাষীদের জানা অত্যন্ত জরুরী। তাই এখন অনেক ফীড কোম্পানি আছে, যারা ফীড সাপ্লাইয়ের সাথে সাথে টেকনিশিয়ানদের মাধ্যমে দিকে দিকে ক্যাম্পনিং করিয়ে চাষীদের সচেতন করছে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের কথা জানিয়ে আসছে। এছাড়াও অধ্যাপকেরা এসে সচেতনতা মূলক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে এর প্রচার করে আসছে। এইভাবে প্রত্যেকের মিলিত প্রয়াসে চাষিরাও চেষ্টা করছে তা অর্জন করার। এখনও পর্যন্ত ভারতবর্ষে ভেনামি চাষে সবচেয়ে এগিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং আরও রয়েছে গুজরাট, মহারাষ্ট, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা। শুধু তাই ই নয় এর ইন্টারন্যাশানাল মার্কেটও রয়েছে এর প্রচুর। বিশ্বের মধ্যে ভেনামি কালচারে ভারত দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এবং প্রথম স্থানে রয়েছে চিন। অতএব সঠিক পদ্ধতি এবং উপযুক্ত ব্যাবস্থপনাই ভেনামি চাষের সাফল্যের চাবিকাঠি।
তবে হ্যাঁ যেটা না বললেই নয়, শুধুমাত্র ভেনামি কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাকি জীব বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে বৈকি। তবে সেক্ষেত্রে ‘পেডি কাম প্রন কালচার’ করা যেতে পারে, যা বিশেষত কেরালায় খুব প্রচলিত। যেখানে একই সাথে চিংড়ি এবং ধান চাষ করা হয়। ফলে একই জমিতে স্থল এবং জল এই দুইয়ের শস্যই পাওয়া যায়। ফলে জীব বৈচিত্র্যও রক্ষা হল এবং উৎপাদনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক উন্নতিও হল।
খুশি প্রধান
Share your comments