কথায় আছে, বন্যেরা বনে সুন্দর। বিবর্তনের অমোঘ নিয়মে প্রকৃতি তার প্রতিটি উপাদানের (জৈব ও অজৈব) জন্য সুনির্দিষ্ট বাসস্থান তৈরি করেছে। প্রাণিজগতের বিভিন্ন প্রাণীর বিবর্তনও হযেছে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং জলবায়ুর ওপর ভিত্তি করেই। একই বর্গের দুটি ভিন্ন প্রজাতির প্রাণির উৎপত্তিস্থলের ওপর তাদের বাহ্যিক ও শারীরবৃত্তীয় গঠন প্রভাবিত হযে সুন্দর বৈচিত্রের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি একদিনে হয়নি; লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলে আসা এই বিবর্তন এখনও বহাল আছে।
কিন্তু যখনই কোনো এক বা একাধিক প্রাণি বা উদ্ভিদ তার ঘরোয়া পরিবেশ ছেড়ে অন্য অচেনা পরিবেশে আসে, এবং ধীরে ধীরে সেখানকার জলবায়ু, মৃত্তিকা এবং সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, এবং সেখানকার স্থানীয় জীবজগতের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে, তখন ওই জীবকে ওই বাস্তুতন্ত্রের নিরিখে Invasive Species বা আক্রামক প্রজাতি বলে। এই আক্রামক প্রজাতি বিভিন্ন পথে তার এই নতুন বাসস্থানে আসতে পারে। ব্রিটিশদের হাত ধরে এদেশে চলে আসা কচুরিপানার সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। সুন্দর নীল ফুলের আকর্ষণে সুদূর আমেরিকা থেকে আনা এই উদ্ভিদ প্রজাতি আজ বাংলা তথা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং স্বাভাবিক জলজ জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে।
আরও পড়ুনঃ গ্রামীন উন্নয়নে অর্থকরী দুটি সম্ভবনাময় প্রকল্পের দিশা
এবার আমাদের মূল আলোচনায় আসা যাক। আর পাঁচটা জীবের মতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছও বিভিন্ন সময় বাইরের থেকে এদেশে এসে এখানকার জলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এই পরিবেশের সাথে খাপ খাইযে বংশবিস্তার করছে। আমাদের অগোচরে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত একাধিক মাছকেই চাষের উদ্দেশ্যে বাইরের দেশ থেকে ভারতে আনা হয়েছে।
যেমন উল্লেখ করা যায় গ্রাস কার্প ও সিলভার কার্পের কথা। এই মাছগুলো দীর্ঘদিন যাবত ফিশারিতে চাষ ও বাজারে বিক্রি হয়ে চলেছে অথচ এর উৎপত্তি কিন্তু ভারতে নয়। এছাড়া আরো উল্লেখযোগ্য মাছ হল তেলাপিয়া ও নাইলোটিকা; যাদের সুদূর আফ্রিকা থেকে আনা হযেছিল, কিন্তু এখানে এসে তারা এক জনপ্রিয় আহারে পরিনত হয়েছে। তবে বাইরে থেকে আসা সব মাছই খাদ্যের উদ্দেশ্যে নয় এমনটা নয়। শখের অ্যাকুরিয়াম প্রতিপালকদের পছন্দের বহু রঙিন মাছই এদেশের নয়।
গাপ্পি, গাম্বুসিয়ার মতো মাছ প্রথমে তাদের সুন্দর রংবেরঙের বাহ্যিক কারুকার্যের জন্য আনা হলেও, লার্তাভুক এই মাছকে সরকারি উদ্যোগে ডেঙ্গু দমনের কাজে লাগানোর স্বার্থে চাষ করা হয় এবং শহরাঞ্চলের নর্দমায় ছাড়া হয়। যদিও সেইক্ষেত্রেও এরা খুব বেশি প্রভাব দেখাতে পারেনি, কিন্তু বহিরাগত এই মাছ এখন এদেশের জলে ছড়িয়ে গেছে। অ্যাকুরিয়ামের উদ্দেশ্যে আনা আরেক মাছ যা সম্প্রতি দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো সাকার ফিস বা গ্লেকো।
গাঢ় রঙ, ভীষণ শক্ত আবরণ ও ধারালো পাখনাযুক্ত এই মাছের প্রধান খাদ্য শ্যাওলা হলেও আদতে এটি সর্বভুক। আজগুবি দেখতে ও কাঁচে জমা শ্যাওলা পরিস্কার করে এই কারণেই অ্যাকুরিয়াম প্রতিপালকরা সাকার ফিসের আমদানি করায়, কিন্তু এর অতি দ্রুত বৃদ্ধির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে একটু বড় হলেই তারা মাছটিকে পুকুর বা নদীতে ছেড়ে দেয়। এই মাছ সেখানে অন্যান্য দেশীয় মাছকে খাদ্যের জন্য টেক্কা দিয়ে জলাশয়ের খাদ্য উপাদানের একটা বড় অংশ শেষ করে দেয়। ফলে অন্যান্য মাছের খাদ্যসংকট দেখা দেয়। গ্লেকোর পাখনার আঘাতে অন্যান্য মাছ আহত এবং পরে সেই আঘাত থেকে পচনের সৃষ্টি হতে পারে। এই মাছ একবার পুকুরে ঢুকলে তা মাছ চাষিদের জন্য ব্যাপক দুশ্চিন্তার বিষয় হযে ওঠে। বহিরাগত মাছের প্রজাতির মধ্যে কোন মাছ কতটা বেশি সমস্যাজনক তা অনেকসময় নির্ভর করে মাছের খাদ্যের ওপর।
আরও পড়ুনঃ স্বল্প পরিসরে মাছ চাষ করুন, রইল সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক পরিকল্পনা
একদিকে গ্রাসকার্পের মতো মাছ জলের শ্যাওলা ও জলজ উদ্ভিদকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে, আবার অন্যদিকে রয়েছে রূপচাঁদের মতো রাক্ষুসে পিরহানা প্রজাতির মাছ। সর্বভুক এই মাছ ব্যাপক ধারালো দাঁত দিয়ে জলাশয়ের অন্য ছোটো মাছ, জুপ্ল্যাঙ্কটন ইত্যাদির ওপরও আক্রমণ করে। লালচে রঙের পেট বিশিষ্ট এই পিরহানা মাছকে বাজারে অসৎ ব্যবসায়ীরা পমফ্রেট হিসেবে বিক্রির চেষ্টাও করে। বহিরাগত আক্রামক প্রজাতির মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি একদিকে পরিবেশের ভারসাম্যের আঘাত হানছে।
এই সমস্ত মাছের দ্রুত বংশবিস্তারের ফলে জলাশয়ে খাদ্য সংকট দেখা যাচ্ছে যার ফলে দেশীয় মাছকে এক অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অ্যালিগেটর গার এর মতো রাক্ষুসে মাংসাশী মাছ নদীতে ছড়িয়ে পড়ে দেশীয় ছোটো ও মাঝারি মাছের প্রজাতির মাছকে মেরে ফেলছে। মাছচাষের ক্ষেত্রেও জলাশযে এইরকম মাছের প্রবেশ চাষীদের প্রচুর ক্ষতি করতে পারে। বর্ষাকালে ভরা পুকুরের জল উপচে এক পুকুর থেকে আরেক পুকুরে এইসব মাছ ছড়িয়ে পড়ে।
অনেক চাষী বিক্রির উদ্দেশ্যে খাই সরপুঁটি, সিলভার কার্প বা খাই মাগুর জাতীয় মাছের চাষ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ওই পুকুরে নজরদারি বাড়ানো এবং বর্ষার আগেই পুকুরের চারদিকে শক্ত জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া দরকার। বিদেশি রঙিন মাছ অ্যাকুরিয়ামের জন্য আমদানি করা হলে তার সুনির্দিষ্ট ছাড়পত্র ও নজরদারির ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে কোনো ভাবেই তারা বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মিশে না যেতে পারে। এবং সর্বোপরি, মাছ চাষী ও অ্যাকুরিয়াম প্রতিপালকদের মধ্যে এই নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের সাথে সাথেই পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা আমাদের কর্তব্য এবং সেই লক্ষ্যে সমস্ত রকমের প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।
সৈকত মাইতি (বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, ডিপার্টমেন্ট অফ জুলজি, মেদিনীপুর), ডঃ প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিজ্ঞানী, ICAR-Bhubaneswar)
Share your comments