পেয়াজ-যাকে আমরা ‘কন্দ পেঁয়াজ’ বা সাধারণ পেঁয়াজ বলেই জানি, এটি এমন একটি ফসল যা খুব ব্যাপক ভাবে আমাদের দেশে চাষ করা হয়ে থাকে, যা ‘allium cepa’ প্রজাতির একটি ফসল। আমাদের দেশে এই পেঁয়াজ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় প্রধানত গ্রীষ্মকালে।
জলবায়ু ও মৃত্তিকাঃ
পেঁয়াজ একটি বিশাল জলবায়ু অঞ্চলে খুব বেশি পরিমাণে চাষ করা হয়, কিন্তু এটি প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। এই ফসল চাষে অধিকমাত্রায় বৃষ্টিপাতের দরকার, অর্থাৎ এই ফসল নিরক্ষীয়, ক্রান্তিয় ও উপক্রান্তিয় অঞ্চলে খুব বেশি পরিমাণে চাষ করা হয়ে থাকে। ভারতে খুব স্বল্প দিনে সমতলভূমিতে পেঁয়াজ চাষ হলেও দিনের দৈর্ঘ্য থাকতে হবে ১০-১২ ঘণ্টা। দীর্ঘ দিনের পেঁয়াজ চাষ হয় সাধারনতঃ পাহাড়ি অঞ্চলে, যখন দিনের পরিমাণ থাকতে হবে ১৩-১৪ ঘন্টা। সবজি বা কন্দ হিসেবে পেঁয়াজ চাষের জন্য গড় তাপমাত্রা দরকার যথাক্রমে ১৩-২৪ ডিগ্রী ও ১৬-২৫ ডিগ্রী। ৭০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় পেঁয়াজ খুব ভালো বৃদ্ধি পায়। এই ফসল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হতে হবে গড়ে ৬৫০ থেকে ৭৫০ মিলিলিটার। এক্ষেত্রে অবশ্য বৃষ্টিপাতের ভারসাম্য থাকা ভালো, আসলে ৬৫০ মিলির কম বা ৭৫০ মিলির অধিক বৃষ্টিপাত খারিফ শস্যের জন্য মোটেই ভালো নয়।
পেঁয়াজ চাষের মাটিতে অবশ্যই জৈব পদার্থে পরিপূর্ণ হতে হবে। মাটি সুস্থ ও নিরোগ হতে হবে। ক্ষেতের চারপাশ আগাছামুক্ত থাকতে হবে ও বৃষ্টির জল বেরিয়ে যাবার ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। পেঁয়াজ বালিমাটি, এঁটেল মাটি, কাদামাটি, পাথুরে মাটি যেকোনো প্রকার মাটিতে জন্মায়। পাথুরে মাটিতে যদি জৈবসার প্রয়োগ করা যায় তাহলে সেখানেও সফলভাবে অধিকমাত্রায় উৎপাদন সম্ভব। পেঁয়াজ চাষের ক্ষেত্রে মাটির pH-এর মান থাকতে হবে ৬.০-৭.৫ মাত্রার আশেপাশে, কারণ এর চাষে মাটির প্রকৃতি সামান্য ক্ষারকীয় থাকতে হবে।
AGRI Found Dark Red (AFDR)
মাঝারি-বড় আকারের কালচে লাল রঙের কন্দপেঁয়াজ পাওয়া যায় গড়ে প্রতি একরে ১২০ কুইন্ট্যাল। এই ধরণের পেঁয়াজ সাধারণত উৎপাদিত হয় খারিফ ঋতুতে।
বীজ বপনের সময়কালঃ
কন্দপেঁয়াজ বীজ বপনের সঠিক সময়কাল হল জুনমাসের মাঝামাঝি। অবশ্য এর ক্ষেত্র তৈরী করে রাখতে হয় মার্চমাসের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে।
বীজের দর
কন্দপেঁয়াজ এর চাষের জন্য হেক্টর প্রতি ৫-৭ কেজি বীজ কেনা প্রয়োজন। অবশ্য বীজের ব্যপারে ভালো সংস্থার বীজ কেনাই ভালো। তাছাড়া সরাসরি বীজ বপনের ক্ষেত্রে, প্রতি ক্ষেত্রে ১.৬-২ কেজি সংশিত বীজের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
চারাগাছের নার্সারি তৈরিঃ
ক্রমিক সংখ্যা |
অঞ্চল |
শস্যের ধরণ |
চারাগাছ প্রস্তুত |
চারার ক্ষেত্র স্থানান্তর |
১ |
মহারাষ্ট্র |
খারিফ |
আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি |
অক্টোবরের মাঝামাঝি |
২ |
মহারাষ্ট্র |
রবি |
অক্টোবরের প্রথমে |
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি |
৩ |
উত্তর ভারত |
খারিফ |
জুন-জুলাই |
জুলাই-আগষ্ট |
৪ |
উত্তর ভারত |
রবি |
অক্টবর-নভেম্বর |
ডিসেম্বর-জানুয়ারি |
৫ |
মধ্যপ্রদেশ |
রবি |
ডিসেম্বর |
জানুয়ারি |
৬ |
পার্বত্য অঞ্চল |
খারিফ |
মার্চ-মে |
এপ্রিল-জুন |
৭ |
অন্ধ্রপ্রদেশ |
রবি |
অক্টোবর-নভেম্বর |
নভেম্বর-ডিসেম্বর |
চারাগাছের নার্সারিবেড মাটির থেকে ২০ সেমির মতো উঁচু করতে হবে। নার্সারির জায়গাটি ১ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত চওড়া করতে হবে, অবশ্য নার্সারি ক্ষেত্রটি কতখানি লম্বা বা চওড়া হবে তা নির্ভর করে বীজের সংখ্যা কত তাঁর উপর। মোটামুটি নার্সারি বেড ও নার্সারির ক্ষেত্রের মধ্যে অনুপাত হতে হবে ২০ঃ১। বীজ বসানোর আগে পর্যন্ত ক্ষেত্রের মাটিকে ৫ থেকে ৬ বার লাঙ্গল মারতে হবে যাতে মাটির ডেলাগুলি ভেঙ্গে যায়, এবং এমনভাবে এগুলো গুঁড় হয়ে যায় যাতে মাটির জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। প্রতি চারার মধ্যেকার দূরত্ব হতে হবে ৩০ সেমি, ফলে জমির অতিরিক্ত জল ওই ফাঁকা জায়গা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। এই নার্সারিবেডকে দিনের অত্যাধিক তাপমাত্রা থেকে বাঁচার জন্য পলিসেড্ দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এই ঘাসের বা পলিপ্লাস্টিকের আচ্ছাদনকে একমাস পর্যন্ত রেখে দিতে হবে যতদিন না পর্যন্ত চারাগুলি শক্তপোক্ত হয়।
কন্দ রোপন প্রযুক্তি
ছোটো ও মাঝারিমানের কন্দ ১০-১২ কুইন্ট্যাল, প্রতি কন্দে ১৫ সেমি দূরত্বে ও প্রতি লাইনে ৩০ সেমি দূরত্ব বপন করতে হবে। কন্দ বপনের ১ থেকে ২ দিন অন্তর অন্তর জলসেচ করা উচিত।
সার প্রয়োগ
এই ফসল চাষের জন্য একর প্রতি ২০ টন জৈব সার, ৪০ কেজি নাইট্রোজেন বা ৯০ কেজি ইউরিয়া সার ও ২০ কেজি পটাশিয়াম পেন্টাক্সাইড বা ১২৫ কেজি সিঙ্গেল সুপার ফসফেট এবং ২০ কেজি পটাশিয়াম অক্সাইড বা ৩৫ কেজি মিউরিটস অব্ পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। সমস্ত সারের অর্ধাংশ চারা স্থানান্তরের আগে প্রয়োগ করতে হবে আর বাকি সারটি চারা স্থানান্তরের চারমাস পরে প্রযুক্ত হবে।
চারা স্থানান্তরিতকরণ
যখন প্রতিটি চারার বয়স ৬-৮ সপ্তাহ ও উচ্চতা ১৫ সেমি পর্যন্ত হবে তখন তাদের বীজতলা থেকে প্রধান ক্ষেতে স্থানান্তরিত করতে হবে। এই সময় প্রতি চারার মধ্যেকার দূরত্ব হতে হবে ২০ সেমি। চারা স্থানান্তরকরণের পর পরই একবার জলসেচ করে নিতে হবে। চারা স্থানান্তরকরণের কাজটি মূলত সন্ধ্যাবেলাতেই করা উচিত যাতে স্বল্প আলোয় সুস্থ থাকতে।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ
পেঁয়াজ চাষে জমির আগাছাকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে, এর জন্য অবশ্যই আগাছানাশক ব্যবহার করা উচিত।
ফসল তোলা
ভালো ফসল তোলার প্রধান রহস্য হলো সঠিকভাবে বীজ বপন বা মূখ্য বৃদ্ধিকালে গাছের সঠিক পরিচর্যা। সাধারণতঃ ডিসেম্বর মাসে ফসল তোলা হয়। এই ফসলের রোগ বা পোকাজনিত কোনো সমস্যা নেই। তবে আর্দ্রতাজনিত কারণে অনেক সময় পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়, সেইজন্য সদ্য উৎপাদিত ফসলকে শুষ্ককরণের জন্য সবসময় মুক্ত আলোবাতাসপূর্ণ গুদামঘরে রাখা উচিত, কারণ মুক্ত বাতাস পেঁয়াজের পচনের হাত থেকে রক্ষা করে।
- প্রদীপ পাল
Share your comments