‘সবজি চাষের প্রেক্ষিত’
জুন মাস মানেই মনে পড়ে যায় ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের কথা। বর্তমানে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা আমাদের কাছে সবথেকে বড় এক সমস্যা। এদিকে জনসংখ্যার চাপ ও চাহিদার বাজারে কাঁচা আনাজ সব মরশুমেই প্রয়োজন আর মরশুম ভেদে সবজির দামও থাকে উর্ধমূখী। বর্তমানে সবজি প্রজনকদের বিস্তৃত গবেষণার ফলে “Seasonal barrier” ভেঙে গেছে মানে সোজা কথায় বলতে হলে কোন একটি সবজি আর একটি নির্দিষ্ট মরশুমই শুধু পাওয়া যায় এরকমটা নয়। একের বেশী মরশুমে তার উপস্থিতি চাষিদের আয় বাড়িয়েছে।
‘পরিবেশ নিয়ে চিন্তা’
এই অসময়ের সবজি চাষ মূলত নানা হাইব্রিডের মাধ্যমে আমাদের রাজ্যে এখন বহুল প্রচলিত আর চাষিরা ‘ইনটেনসিভ’ সবজি চাষে ঝুঁকেছেন। তবে অসময়ের সবজি চাষে রোগ পোকার আক্রমণ খুব বেশী হবার প্রবনতা থাকে। তার সঙ্গে হাইব্রিড গুলিতে সারের চাহিদা তুলনামূলক কিছুটা বেশী। চাষিরা বেশী দামের আশায় এতসব না বুঝে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার করেন, আর সঙ্গে বেশী বেশী সার । সবজির পাইকারী দাম বাজারে চড়তে শুরু করলেই আমাদের রাজ্যের চাষিদের তখনকার সেই সবজির জমিতে খরচের প্রবনতাও বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সার ও কীট/ রোগনাশকের ব্যবহার। ফলে চাষের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জমিতে রাসায়নিক সারের দূষণ জলে, খাদ্যেও আর পরিবেশে সেসব রাসায়নিকের কুপ্রভাব বাড়িয়ে চলে। কীট / রোগনাশকের কথা তো আরো ভয়াবহ – প্রতিটি চমৎকার চকচকে সবজির পিছনে “পেস্টিসাইড রেসিডিউ” অনেকটা। ফলে প্রতিদিন পরোক্ষে আমরাও খেয়ে চলেছি বিষ। আর পরিবেশের নানা অংশে সেসব বিষের প্রভাবের কথা বলতে গেলে আলোচনার শেষ থাকবে না।
সমস্যার সমাধান ‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ সবজি চাষ
তাই বলে কি চাষিরা চাষ বন্ধ রাখবেন? এই বিপুল জনসংখ্যার চাহিদার কথা বাদ দিয়ে হাইব্রিড চাষ করবেন না? আর রাসায়নিক মুক্ত ১০০% জৈব চাষ? জৈব চাষের উদ্দ্যোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশ কিছু প্রগতিশীল চাষি ও সংস্থাগত ভাবে প্রচেষ্টা করে গড়ে তোলার অবস্থা হলেও ব্যপক আকারে জৈব চাষ চাষিদের কাছে প্রায় অসম্ভব। তাহলে, কিভাবে সবজি চাষকে বর্তমানে দিক নির্দেশ করা যাবে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে কিছু আধুনিক প্রযুক্তির দেশীয় পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে পরিবেশের উপাদান গুলি ব্যবহারের মাধ্যমে। যাতে কীট / রোগ নাশক প্রয়োজন অনুসারে লাগে আই. পি. এম মেনে আবার, রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে প্রায় ৩০% মত। এর সাথে মাটির কথা মাথায় রেখে জৈব সার ও উপাদানের ব্যবহার আমাদের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখে।
কি কি ভাবে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ সবজি চাষ?
১) প্লাগ ট্রে ও নেটে ভাইরাস ফ্রী নার্সারী - প্রথমে নার্সারী দিয়ে শুরু করা যাক, কারণ বেশীরভাগ লাভজনক অসময়ের সবজিরই চারা তৈরি করে রোয়া করে চাষ করা হয়। যেমন সমস্ত কপি, টমাটো, বেগুন, লঙ্কা ইত্যাদি। আর এসব ক্ষেত্রে বিশেষ করে কপিতে বর্ষা ও পূজোর মুখে চাষে একপেশে ধ্বসা ও হলুদ হয়ে যাওয়া আর টমাটো, লঙ্কাতে শোষক পোকা জনিত ভাইরাস সমস্যায় পরবর্তীতে চাষিরা যথেচ্ছ স্প্রে করেন। তবে সমস্যার সমাধান খুব একটা হয় না। আবার বর্ষাকালে বীজতলা বা চারা তলার জন্য চাষিরা জেরবার হন। সাথে অত্যধিক স্প্রে সমস্যা তো থাকেই।
ফলে বর্তমানের পলিথীনের ছোট ‘প্লাগ’ / ‘পোর’ ফুটো সমন্বিত নার্সারী ব্যবস্থা এক স্মার্ট পদ্ধতি চারা তৈরীর ব্যবস্থাপনায়। এই ট্রেতে মাটির বদলে নারকেলের ছোবরা থেকে তৈরি মিডিয়াম ‘কোকোপিট’ ব্যবহার করে একটি করে বীজ ফেলে সুন্দর সুস্থ চারা করা যায়। বাইরে বর্ষা হলেও ট্রেগুলি আচ্ছাদনের মধ্যে বা বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরোয়া পরিকাঠামোয় পলিশীট ঢেকে রাখা সম্ভব। আর এর সঙ্গে শোষক পোকা রোধক ইনসেক্ট ফ্রী ৪০-৫০ মেশ নেটের মধ্যে প্রাথমিক নার্সারী পর্য্যায় টুকু ফসলের অতিবাহিত হলে পরবর্তীতে বাহক দ্বারা ভাইরাস আক্রমণ অনেকটা এড়ানো যায়। ফলে রাসায়নিক বাঁচিয়ে সুস্থ সবল চারা বেশী লাভের বাজার ধরতে চাষিকে এগিয়ে রাখে। এই রকম ট্রে তে নার্সারী বা বীজতলা আর উপরে পলিশীট আর পাশে নেট দিয়ে পরিকাঠামো চাষিরা সহজেই বানিয়ে দুর্দান্তভাবে সবজির বীজতলাকে স্মার্ট রূপ দিতে পারেন।
২) পলি টানেলে সবজি – পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে কুমড়ো জাতিয় সবজি ফাল্গুনের প্রথম বাজারে ভালো দাম দেয়। কিন্তু চাষিরা শীতের মধ্যে মাঠে কুমড়ো জাতীয় সবজির বীজ বুনলে ঠান্ডায় অন্কুরোদ্গম হয় না ও ঠান্ডার সময়ে করলা, ঝিঙ্গে, শশা ইত্যাদির চাষও সম্ভবপর হয় না। তবে ছোট পলি গ্লাসে নিচে একটি ফুটো করে এর মধ্যে কেঁচো সার সমেত মাটি মিশ্রণ ভরে প্রতি পলি গ্লাসে একটি করে বীজ চাষিরা লাগাতে পারেন, ভরা শীতের সময় – মানে পৌষের মাঝামাঝি। এই পলি গ্লাসের সংখ্যা মূলজমিতে যতগুলি মাদা হবে তার থেকে ১০% বেশী করলেই চলবে, অর্থাৎ মাদা পিছু একটি গাছ। আর কিছুটা বেশী ক্ষয়-ক্ষতি ‘মেক আপ’ দিতে। এবার একটি সুবিধাজনক স্থানে যেখানে সবসময় সূর্য্যালোক থাকে সেখানে সামান্য মাটি চেঁছে তুলে পলি গ্লাস গুলি পাশা পাশি বসিয়ে উপরে স্বচ্ছ পলিশীটের (১০০ মাইক্রন) টানেলের মত পরিকাঠামোয় ঢাকা করে দিতে হবে বাঁশের বাতা দিয়ে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে পরলিশীট চারিদিকে মাটি বা ইঁট চাপা থাকে। শীতের সময় সকাল থেকে পলিটানেল ঢাকা থাকার পর দুপুর বেলা পলিশীট তুলে জল দেওয়া ও পরিচর্যার কাজ করে আবার রোদ থাকতে টানেল বন্দী করে দিতে হবে। ফলে সূর্য্যালোক টানেল বন্দী পলি গ্লাসের কুমড়ো সবজিকে গরম আবহাওয়ায় বড় চারা করে তুলবে মাস খানেকে। আর মাঘ মাসের মাঝামাঝি থেকে গরম বাড়তে শুরু করলে মূল জমিতে মাদা তৈরি করে পলিটানেলের এক হাত লম্বা চারা একটি করে লাগিয়ে দিলেই কিছুদিনের মধ্যেই মাচায় তোলার উপযুক্ত বা বড় হয়ে ফলন দেবে ফাল্গুনের প্রথমেই। ফলে এই ‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ প্রযুক্তিতে স্প্রে বাঁচবে, রাসায়নিক সার বাঁচবে আর চাষি থাকবে লাভের দিকে।
৩) শেড নেট ও পলি হাউসে সবজি – গরমের সময় টমাটো, ধনেপাতা বা পালং খোলা মাঠে চাষে অসুবিধা অনেক। তবে বর্তমানের নানা উন্নত জাত ও হাইব্রিডে গরমে চাষ সম্ভব হলেও গুনমানকে ধরে রাখতে ও রোগপোকা ঠেকাতে স্প্রে করতে হয় বেশী। তার বদলে বর্তমানে উপলব্ধ ৫০% সবুজ শেডনেটের আচ্ছাদন উপরে ফুট আটেকে বাঁশ দিয়ে ঢাকার ব্যবস্থা করে এসব সবজি চাষ খুব ভালো ভাবে সম্ভব। সরকারী অনুদান ব্যবস্থাও এতে চালু আছে ফলে জি. আই. পাইপ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী শেড-নেট হাউসে সবজি চাষ এখন চাষিদের কাছে এক ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে।
একই কথা খাটে পলিগ্রীন হাউসের ক্ষেত্রে। এতে পুঁজি ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকলে পুরো হাইটেক বা কম খরচে পাশে খোলা ‘ওপেন ভেন্টিলেটেড’ পরিকাঠামোতে অসময়ের প্রায় সবরকম সবজি চাষ আর উচ্চ আয়ের সবজি যেমন ক্যাপসিকাম করা সম্ভব। আর এতে ড্রিপ ব্যবস্থায় জলসেচ থাকলে রাসায়নিক সারের অপব্যবহার ও অপচয় অনেকটা কমাবার সঙ্গে কীট / রোগনাশক স্প্রেও যথাযথ দেওয়া সম্ভব। আর চাষিদের লাভের দিকটা তো ছেড়েই দিলাম। এই রাজ্যের প্রায় প্রতি জেলাতেই সফল চাষিদের কাহিনী না হয় পরে আলোচনায় থাকবে।
৪) পলি মাল্চিং ও দেশীয় ব্যবস্থায় মাল্চে সবজি – পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল বাদে বাকী সব জায়গায় সবজি চাষে আগাছা একটি বড় সমস্যা। আর আজকের বাজারে সবজি থেকে লাভ পেতে চাষিরা ঘাড়ের উপর ঘাড়ে ফসল ফলাতে অভ্যস্ত। সেচ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন জমি খালি পড়ে থাকে কই? তবে আগাছানাশে বেশী শ্রম খরচ কমাতে আর লাভের কড়ি গুনতে চাষিরা জমিতে ‘টোটাল উইড কিলার’ দিয়ে দেন বছরে প্রতি মরশুমের শুরুতেই। ফলে জমির অবস্থা যে কি হচ্ছে আর পরিবেশে মিশছে বিষ। আগাছার সমস্যা রোধে ‘মাল্চিং’ এক কার্যকরী ‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ পদ্ধতি। সবজি চাষে চারা বা বীজ বসানোর আগে উঁচু বেডে জমি ভাগ করে বেডের উপর পলিশিটের মাল্চ পেতে দিলে আগাছার সমস্যার সাথে জলসেচ কম লাগে, তাপ নিয়ন্ত্রিত হয় সাথে রোগ পোকাও কম লাগে। বর্তমানে পলি মাল্চের উপর ফুটো করে সেই স্থানে চারা ও বীজ লাগিয়ে সুন্দর মাল্চের উপর সবজি চাষ সম্ভব হচ্ছে। খুব বর্ষাকাল বাদে শীতে ও গ্রীষ্ম - প্রাক গ্রীষ্মে মাল্চিং এক কার্যকরি পদ্ধতি। তবে বর্ষাতে উঁচু জমিতে একটু উঁচু করে মাল্চিং করে জল নিকাশী ভালোভাবে করলে চমৎকার স্মার্ট পদ্ধতিতে আগাছার সমস্যা মিটিয়ে সবজি পাবেন। বিশেষ করে এই মাল্চে কনজারভেশন হবার জন্য উৎপাদনও দেড়গুণ বেড়ে যায়। আর এর সাথে ড্রিপ ব্যবস্থা চালু থাকলে দুগুন ফলন অনায়াসে সম্ভব। পলিমাল্চ সম্ভব না হলে প্রাক গ্রীষ্মের জমিতে বাওয়া সবজি বা শীতের সবজিতে খড় বা ফসলের অবশেষ ইত্যাদি দিয়ে মাল্চেও বেশ কিছুটা লাভ পাওয়া সম্ভব।
৫) ড্রিপ সেচ ব্যবস্থায় ফার্টিগেশন ও ওয়াটার সলিউবল বায়োসার – বর্তমানে মাটিতে রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহার ও রাসায়নিক প্রয়োগ সবজি চাষে বিশেষ করে ‘ইনটেনসিভ চাষ ব্যবস্থা’ ও হাইব্রিডের ব্যবহারকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই বিপুল জন সংখ্যার চাহিদা ও চাষিদের উৎপাদন থেকে লাভ এটাও তো মাথায় রাখতে হবে। তাই বর্তমানে অনুসেচ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে কিছু সবজি জমিতে নিয়ে আসতে হবে। এতে ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ জলের অপচয় রোধ করে আর্সেনিকের সম্ভাব্য কবল থেকে পরিবেশ রক্ষা করা যাবে। আর সবজি চাষে কি কি সুবিধা হবে –
- রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো যাবে আর বায়ো এন-পি-কে বা জৈব / বায়ো জলে গোলা সার বা রাসায়নিক জলে গোলা সার কেবলমাত্র প্রয়োজন মত ড্রিপের জলের মাধ্যমে ‘ফার্টিগেশন’ করে অনেক কম অথচ উপযোগী ব্যবহার হবে।
- ড্রিপ ব্যবস্থার মাধ্যমে যতটুকু জল দরকার ততটুকু ‘রুট জোনে’ পড়বে ফলে প্রভূত জলের অপচয় কমিয়ে ফলন দুগুন হবে।
- কীট বা রোগনাশক ও ড্রিপ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেওয়া যাবে ফলে যথেচ্ছ ব্যবহার কমিয়ে প্রয়োজনমত ‘টার্গেট ওরিয়েন্টেড’ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
- আর এসব ব্যবস্থায় পরবর্তীতে শ্রম-খরচ কমিয়ে লাভ বাড়ানো যাবে অনেকটাই।
সবশেষে বলি যে, এই ড্রিপ ব্যবস্থার জন্য ইলেকট্রিসিটি বা পাম্প ব্যবস্থার বদলে উচ্চতায় পলিট্যাঙ্ক বসিয়ে তাতে জলভরে জলের চাপের সাধারন নিয়মে বিঘাখানেক জমিতে সুন্দর ‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। প্রয়োজনে বর্ষার জল অপচয় না করে কোন উঁচু জায়গায় চৌবাচ্চায় জমিয়ে রেখে সেই জলের ড্রিপে ব্যবহার সবজি চাষের জন্য এক আশীর্বাদ স্বরূপ হবে। পাঠকরা লেখা ও সংশ্লিষ্ট ছবির মাধ্যমে কিছুটা বুঝতে পারবেন আর আশারাখি সবজি চাষের আগামী দিনকে পরিবেশ বান্ধব অথচ লাভজনক করে তুলুন।
ড: শুভদীপ নাথ
সহ উদ্যানপালন অধিকর্তা, উত্তর ২৪ পরগনা।
‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ সবজি চাষ এর বিষয়ে আরো জানতে চোখ রাখুন কৃষি জাগরণ পত্রিকায় ও কৃষি জাগরণের পোর্টালে।
- রুনা নাথ
Share your comments