আমাদের দেশে চাষবাসে মোটামুটি ২৯ মিলিয়ন টন ইউরিয়ার প্রয়োজন হয়। এই ইউরিয়ার দাম সব সময় নিয়ন্ত্রণ করার পরেও চাষীরা এর দামের জ্বালায় অস্থির থাকে। আবার এটাও বাস্তব নাইট্রোজেন ঘটিত সার ছাড়া ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই এই অবস্থায় চাষীদের যদি খরচ কমাতে হয় তবে বিকল্প কি!? এজোলা! হ্যাঁ, এজোলা অতি অবশ্যই একটি বিকল্প। এটিকে যদি চাষীদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা যায় তবে কমপক্ষে ১৫ মিলিয়ন টন এর ইউরিয়ার খরচা বাঁচানো যেতে পারত এবং জমিকেও সুস্থ রাখা যেত। আজকে যেখানে সবাই বলছে চাষীর দ্বিগুন তিনগুণ লাভ হচ্ছে বা হওয়া উচিৎ বা করবেন বলে পণ নিয়েছেন তাঁরা চাষিদের খরচ কিভাবে কম করা যেতে পারে সেটা নিয়ে কি পরিকল্পনা আছে!? এনিয়ে সঠিক কোনো দিশা দেখাতে পারেন কি!?? আমি মনে করি নেই। কারন হিসেবে অনেকে খাড়া করবেন কিছু সংখ্যা তত্ত্ব যা অনেকেই আমরা জানি আর সেটা করে বেরিয়ে যাবেন। যদিও আমাদের দেশে কিছু কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, কিছু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,এবং কিছু সমাজ সেবী নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এটিকে জনপ্রিয় করার জন্য কিন্তু সেটা সার্বিক ভাবে নয় কেননা তাদের ক্ষমতা আর লোকবল সীমিত।
আর সরকারি কৃষি দফতরের কিছু আধিকারিকগণ উদ্যোগ নিলেও সেটার কোনো সঠিক নিরীক্ষনের সময়ের অভাবে খুব সামান্যই মাঠে এজোলা দেখতে পাওয়া যায় এবং তাঁরাও ওই একই উদাহরণ খাড়া করবেন দিনের শেষে যে সময় কম, লোকবল নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।অর্থাৎ আমাদের দেশে না হওয়ার কারণ খাড়া করতে জুড়ি মেলা ভার।কিন্তু অবস্থা সত্যি কি তাই!? ক্ষেত্র বিশেষে এটি বাস্তব কিন্তু সবটা নয়।আমাদের দেশকে কৃষি প্রধান দেশ বলা হয়।অথচ কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োগ কম,বিজ্ঞান কেন্দ্র গুলির যথেষ্ট তহবিল নেই!!?এই বাস্তব সত্য যদি স্বীকার করি তবে এটাও স্বীকার করতে হয় যে, কৃষকের লাভ দ্বিগুন বা তিনগুণ করার স্বপ্ন আসলে দিবাস্বপ্ন বা রাজনৈতিক ভাওতাবাজি ছাড়া অন্য কিছু নয়।আসলে কেউ স্বীকার করতে চায় না যে কিছু মানুষের দক্ষতার অভাব রয়েছে,আন্তরিকতা ভাবে কাজ করার মানসিকতা র অভাব রয়েছে, চেয়ারে বসে দিন কাটানোর অভ্যাস রয়েছে। যাইহোক ভালো কিছু হবার জন্যই দিন অপেক্ষা করে থাকে। আমরাও আছি।
এবার একটু এজোলা সম্পর্কে জানা যাক:
স্থানীয় ভাবে এজোলা ক্ষুদিপানা, তেঁতুলিয়াপানা, বুটিপানা, কুটিপানা ইত্যাদি নামে পরিচিত। এজোলা ফার্নজাতীয় ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ। তাই ধান ক্ষেত, পুকুর, ডোবা, খাল, বদ্ধ জল ও নদীর জলে জন্মে। এর ভাসমান গুচ্ছগুলো ত্রিকোণাকার। প্রতিটি গুচ্ছের দৈর্ঘ্য ১০-১৫ মিলিলিটার এবং প্রস্থে ১০-১২ মিলিলিটার হয়। প্রতিটি ভাসমান গুচ্ছের প্রধান কার উভয় দিক থেকে ৮-৯টি শাখা বের হয়। প্রতিটি শাখায় ১০-১২টি পাতা উভয় দিকে একটির পর একটি সাজানো থাকে।
বংশ বৃদ্ধি: যৌন (বীজ) ও অযৌন (অঙ্গজ) উভয় পদ্ধতিতে এজোলা বংশ বৃদ্ধি করে। জলে ভাসমান অবস্থায় এজোলার বংশ বৃদ্ধি ভালো হয়। কাদামাটিতে এজোলা বেঁচে থাকতে পারে। সাধারণত ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাই এর অঙ্গজ বংশ বিস্তার দ্রুত হয়। তাপমাত্রা বেশি হলে যেমন চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রচন্ড গরম ও প্রখর রোদে এজোলা বংশ বৃদ্ধি করে না, তবে বেঁচে থাকে।
সার হিসেবে ব্যবহার: এজোলাকে আশ্রয় করে একটি নীলাভ সবুজ শেওলা এজোলার পাতার ভেতরে একটি গর্তে অবস্থান করে এবং বড় হয়। শেওলাটি পাতার ভেতরেই বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। পাতার ভেতরে নীলচে সবুজ শেওলার একটি প্রজাতি (এনাবিনা) থাকে। এজোলার প্রতিটি পাতায় ৭৫ হাজার এনাবিনা থাকে। শেওলাটি বাতাস থেকে ৩-৩.৫% নাইট্রোজেন আহরণ করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া তৈরির মাধ্যমে নিজের ও আশ্রয়দাতা এজোলার জন্য নাইট্রোজেন পুষ্টি জোগায়। উল্লেখ্য, গাছ ইউরিয়া সারের মূল উপাদান নাইট্রোজেনকে অ্যামোনিয়াম আয়ন হিসেবে গ্রহণ করে।
আরও পড়ুন ইউরিয়ার বিকল্প হতে পারে এজোলা
এজোলা প্রতিদিন হেক্টরে এক টন কাঁচা জৈব সার তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে বাতাস থেকে ২ কেজি নাইট্রোজেন আহরণ করতে পারে যা ৫ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। এজোলা যখন জলের উপরিভাগে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে তখন প্রতি হেক্টরে ১০-১৫ টন কাঁচা জৈব সার ও সেই সঙ্গে ২০-২৫ কেজি নাইট্রোজেন আহরিত হয় যা ৪৫-৫৫ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। কাঁচা এজোলায় শতকরা ৬ ভাগ শুকনো বস্তু থাকে। এতে শতকরা ৩-৪ ভাগ
নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ০.২৫-৫.৫ ভাগ, ক্যালসিয়াম ০.৪৫.১.২৫ ভাগ, সিলিকা ০.১৫-১.২৫ ভাগ, সোডিয়াম ০.১৫-১ ভাগ ফসফরাস ০.১৫.১ ভাগ, ক্লোরিন ০.৫-০.৭৫, সালফার ০.২ -০.৭৫ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম ০.২৫-০.৫ ভাগ অ্যালুমিনিয়াম ০.০৪-০.৫ ভাগ, আয়রন ০.০৫-০.৫ ভাগ, ম্যাঙ্গানিজ ৬০-২৫০০ পিপিএম, কপার ২-২৫০ পিপিএম ও জিঙ্ক ২৫-৭৫০ পিপিএম। এজোলা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে এগুলো সবই গাছের পুষ্টি হিসেবে গ্রহণ করে।
চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের কৃষকরা ধানক্ষেতে জীবাণুসার হিসেবে এজোলা চাষ করে। এজোলা ধান গাছে নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করে এবং জৈব পদার্থ মিশে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। আমাদের দেশে অনেক সময় বোরো ও আমনের জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই এজোলা জন্মে। কৃষকরা না জানা ও না চেনার কারণে আগাছা মনে করে জমি থেকে পরিষ্কার করে ফেলে দেয়। অথচ এজোলা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই ১৫ দিনের মধ্যে পচে মাটিতে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। অন্যান্য ফসলের জমিতে এজোলা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ইউরিয়া সারের চাহিদা পূরণ করা যায়। রোপা ধানে এজোলা ব্যবহার করে ২০-২৫ ভাগ ফলন বাড়ানো যায়।
জৈব আগাছানাশক: এটি উপরিভাগ ঢেকে রাখে ফলে সূর্যের আলো জলের নিচে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। এতে শ্রমিকের খরচ সাশ্রয় হয়।
প্রাণীর খাদ্য হিসেবে: এজোলা মাছ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার হয়। এজোলায় প্রচুর আমিষ ও চর্বি থাকায় উচ্চমানের খাদ্য তৈরি হয়। রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এজোলায় আমিষ ২০-২৫%, অ্যাশ ১০%, শ্বেতসার ৬-৬.৫%, চর্বি ৩-৩.৫%, দ্রবীভূত সুগার ৩-৩.৫% ও ক্লোরোফিল এ ০.২৫- ০.৫%। এজোলা তৈরি খাদ্যে মুরগির ডিমের উৎপাদন বাড়ায়, কুসুম বেশি হলুদ বর্ণ হয়, ডিম ও মাংসে বেশি আমিষ থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গবাদিপশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও দুধ উৎপাদন বাড়ে। মাছ চাষে পুকুরে জলে বিশুদ্ধ রাখে ও মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এজোলা দিয়ে পশু-পাখি খাদ্য ও মাছের উৎপাদনে খরচ কম হয়।
এজোলা উৎপাদন: মজা পুকুর, ডোবা, নালা, খাল, বিল এজোলা চাষ করা যায়। এ ছাড়া বোরো ও আমন ক্ষেতেও চাষ করে মাটির সঙ্গে মেশানো যায়। প্রাথমিকভাবে প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০ গ্রাম সতেজ এজোলা বীজ হিসেবে জলাশয় অথবা ধানের জমিতে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতি হেক্টরে ৮-১০ কেজি এসএসপি ৮-১০ কেজি, ১৫-২০ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশে ১০-২০ দিনের মধ্যে এজোলা অঙ্গজ বংশবিস্তার করে। এজোলা উৎপাদনের জন্য ধানের চারা রোপণের ৫-৭ দিন পর বীজ হিসেবে ১০০-১২০ গ্রাম সতেজ এজোলা জমিতে
ছড়াতে হবে। ১৫-২০ দিন পর পর জমির মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয় অথবা উঠিয়ে অন্য জমিতে ব্যবহার করা যায়।
সংরক্ষণ: সারা বছর এজোলার বীজতলা সংরক্ষণ করা যেতে পারে। পুকুর, ডোবা বা বদ্ধ জলাশয়ে সংরক্ষণ করা যায়। অতি বৃষ্টি ও রোদ থেকে রক্ষার জন্য শাক-সবজির মাচা করা যেতে পারে। বীজতলায় সর্বদা ৫-১০ সেমি জল থাকতে হবে।। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য এক গ্রাম এসএসপি ৮-১০ দিন পর পর দিতে হবে। শামুক ও পোকার মাকড় এজোলার ক্ষতি করে। শামুক বেছে ফেলতে হবে। পোকা দমনের জন্য কার্বোফুরান স্প্রে করা যেতে পারে। এজোলা দেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। এ প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগালে ইউরিয়া সাশ্রয় হবে, গ্যাসের সংকট দূর হবে, ফলন বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ রোধ করা, ফসল, মাছ, গবাদিপশু, ডিম ও দুধের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য এজোলা বিরাট ভূমিকা পালন করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
(কৃ:স:এম ইসলাম/বাংলাদেশ)
- অমরজ্যোতি রায় (amarjyoti@krishijagran.com)
Share your comments