চাষের বিভিন্ন পর্যায়ে একেবারে জমি তৈরি করা থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। যত দিন যাচ্ছে, শ্রমিক অপ্রতুলতার কারণে চাষের কাজে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সময়মতো শ্রমিক না মেলায় একদিকে যেমন সময়ে চাষের কাজ শেষ করা যাচ্ছে না, তেমনই শ্রমিকের মজুরি মেটাতে গিয়ে খরচও বাড়ছে কৃষকের। এই পরিস্থিতিতে উন্নত যন্ত্রের ব্যবহার করে অনেক কম খরচে চাষের কাজ শেষ করা যেতে পারে, তেমনই সময়ে কাজ করা যায়। বেশকিছু কৃষক একসঙ্গে মিলে যদি মনে করেন, সেই এলাকার চাষের প্রয়োজনে কোনও যন্ত্র কিনবেন, তা হলে আবেদনের ভিত্তিতে সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগও রয়েছে।
রোটাভেটর যন্ত্রটি ট্রাক্টর দিয়ে চালাতে হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে ৮ ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত মাটি ঝুরঝুরে করে ফেলা সম্ভব। এই যন্ত্র দিয়ে চাষ দিলে পূর্ববর্তী ফসলের অংশ জমির মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে। ফলে মাটির উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধি পায়। ধানের জমি কাদা করতে যন্ত্রটি বিশেষ কার্যকরী। ঘণ্টায় এক একর জমির মাটি ঝুরঝুরে করতে পারে এই যন্ত্র। অসমান কৃষিজমিকে সমান করতে এখন এসে গিয়েছে লেজার ল্যান্ড লেভেলার। এটিও ট্রাক্টরের সাহায্যে চালাতে হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে প্রয়োজনীয় ঢাল বজায় রেখে জমি সমতল করা যায়। ফলে কম জলে তুলনামূলক বেশি জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়। এক একর জমি সমতল করতে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। ঘণ্টায় যন্ত্রটি চালাতে ডিজেল লাগে ৪ লিটার।
জিরো টিলেজ মেশিনের সাহায্যে সরাসরি বীজ বুনে দেওয়া যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন অনেকটা সময় বাঁচে তেমনই মাটির স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। জিরো টিলেজ মেশিনের সাহায্যে বীজ ও সার একইসঙ্গে সরাসরি একই গভীরতায় জমিতে প্রয়োগ করা সম্ভব। এই মেশিনের সাহায্যে ধান, গম, ভুট্টা চাষ করা যায়। এক থেকে দেড় ঘণ্টায় এক একর জমিতে বীজ বোনা যায়।
পট্যাটো প্ল্যান্টার যন্ত্রের সাহায্যে সারিতে আলুবীজ বসানো হয়। এটি ট্রাক্টর দিয়ে চালাতে হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে মাটি কাটা, বীজ বপন ও মাটি ঢাকা দেওয়া, একসঙ্গে করা যায়। এবং সমান দূরত্ব বজায় রেখে আলুর বীজ বসানো যায়। এই মেশিনের সাহায্যে দেড় ঘণ্টায় এক একর জমিতে আলুর বীজ বসানো যায়।
ফোয়ারা সেচ বা ড্রিপ ইরিগেশন আধুনিক সেচ প্রযুক্তি। ফোয়ারা সেচ পদ্ধতিটি হল, কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের মতো। এই সেচে ফসলের পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখতে এবং বাতাসে ধুলিকণার প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। যেসব অঞ্চলে ভূমিক্ষয় বেশি এবং ভূমি অসমান, সেখানে এই সেচ পদ্ধতি বিশেষভাবে কার্যকরী। চা বাগান, ফুল, সব্জির খেতে এই পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যায়। এতে বেশকিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন, সেচের জল নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জলের অপচয় কম হয়। জল সেচের জন্য ভূমিক্ষয় হয় না। ঢালু জমিতেও এই সেচ পদ্ধতি কার্যকরী। সেচের সঙ্গে তরল সার ও কীটনাশক মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ফলে সেগুলি আলাদাভাবে প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। সেচের জন্য জমিতে আলাদা করে নালা তৈরি করতে হয় না। ফলে সময়, খরচ ও জমির অপচয় রোধ করা যায়।
ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতিতে পাম্পের সাহায্যে জল তুলে উঁচু জলাধারে সংরক্ষণ করে রেখে দেওয়া হয়। তার পর সেই জল ফিল্টার করে নেওয়া হয়। যাতে পরিস্কার হয়ে যায়। সেই জল পাইপের সাহায্যে জমিতে প্রবাহিত হয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে পাইপের গায়ে ড্রিপার লাগানো থাকে। সেগুলির স্টপকক খুলে দিলে গাছের গোড়ায় ফোটা ফোটা করে জল পড়তে থাকে। এতে সেচের জলের অপচয় কম হয়। রুখা এলাকায় এই সেচ পদ্ধতি বিশেষ কার্যকরী। এই সেচের মাধ্যমে একইসঙ্গে ফসলে তরল সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা সম্ভব।
কম্বাইন হারভেস্টর নামের ধান কাটার মেশিনের সাহায্যে ধান, গমের মতো ফসল সহজে এবং কম খরচে খুব তাড়াতাড়ি কাটা যায়। দেড় ঘণ্টায় এক একর জমির ধান এই যন্ত্রের সাহায্যে কাটা সম্ভব। জমি থেকে আলু তোলারও যন্ত্র রয়েছে। ট্রাক্টর চালিত এই যন্ত্র দিয়ে একসঙ্গে দু’টি ভেলির আলু তোলা যায়। দেড় থেকে দুই ঘণ্টায় এক একর জমির আলু এই মেশিনের সাহায্যে তোলা সম্ভব। একইসঙ্গে ফসল কাটা, ঝাড়াই ও বাছাই করার জন্য এখন কৃষকের হাতের কাছে রয়েছে কম্বাইন হারভেস্টর। ধান, গম, ভুট্টা, সয়াবিন, তিসির মতো ফসলের ক্ষেত্রে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এক ঘণ্টায় এক একর জমির ফসল কাটা, ঝাড়াই ও পরিস্কার করা সম্ভব হয় এই যন্ত্রের সাহায্যে।
মাল্টি ক্রপ থ্রেশার যন্ত্রের সাহায্যে ধান, ভুট্টা, জোয়ার প্রভৃতি ফসল ঝাড়াই করা যায়। ফসল কাটার পর জমিতে পড়ে থাকা খড়গুলিকে যন্ত্রের সাহায্যে গাঁটবন্দি করা হয়।
ড্রাম সিডার যন্ত্রের সাহায্যে ধানের অঙ্কুরিত বীজ সরাসরি জমিতে বপন করা যায়। রাইস প্ল্যান্টারের সাহায্যে ধানের চারা রোপণ করার জন্য বিশেষ ট্রেতে ধানের বীজ বপন করতে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাকে সিডার মেশিন বলে।
- রুনা নাথ (runa@krishijagran.com)
Share your comments