গ্রীষ্মকাল যখন চরমে থাকে, তখন শরীরে ক্লান্তি, বিরক্তি এবং পানিশূন্যতার মতো সমস্যা বেড়ে যায়। এমন সময়ে, প্রাকৃতিক ভেষজ ও মশলার ব্যবহার শরীর ঠান্ডা রাখতে এবং স্বাস্থ্য বজায় রাখতে খুবই উপকারী। এই প্রাকৃতিক প্রতিকারগুলির সাহায্যে আমরা কেবল সতেজ বোধই করি না বরং অনেক শারীরিক সমস্যাও এড়াতে পারি।
এখানে আমরা কিছু বিশেষ ভেষজ এবং মশলা সম্পর্কে বলছি যা গ্রীষ্মকালে কেবল শরীরকে ঠান্ডা রাখে না বরং অন্যান্য স্বাস্থ্য উপকারিতাও প্রদান করে।
মেথি
গ্রীষ্মকালে শীতলতা বজায় রাখার জন্য মেথি বীজ অন্যতম সেরা প্রাকৃতিক প্রতিকার। এই বীজগুলি শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। উপকারিতা পেতে, কিছু মেথি বীজ রাতভর জলে ভিজিয়ে রাখুন এবং জল ছেঁকে সকালে পান করুন। এই পদ্ধতি শরীরকে ঠান্ডা করে এবং পাচনতন্ত্রকেও শক্তিশালী করে।
মেথি প্রদাহ কমাতেও পরিচিত, যার ফলে শরীরের অভ্যন্তরে প্রদাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। শীতল প্রভাব ছাড়াও, মেথি বীজ আরও অনেক উপকারিতা প্রদান করে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, কোলেস্টেরল কমায় এবং মহিলাদের হরমোনের ভারসাম্য উন্নত করতে সাহায্য করে। এতে উপস্থিত ফাইবার দীর্ঘ সময় ধরে পেট ভরা অনুভব করে, যা ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে।
মেথি খাবারে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারে। উদাহরণস্বরূপ, মেথি গুঁড়ো 'পুলুসু' নামক একটি টক সবজিতে যোগ করা হয় এবং 'মেথি মাজিগ' (বাটারমিল্ক) মেথি বীজ, সরিষা বীজ এবং কারি পাতা দিয়ে মেশানো হয়। অঙ্কুরিত মেথি বীজ সালাদে যোগ করা যেতে পারে অথবা সবজির সাথে রান্না করে খাওয়া যেতে পারে।
পুদিনা (মেন্থা স্পিকাটা)
পুদিনা একটি ঐতিহ্যবাহী শীতল ঔষধি, বিশেষ করে এতে মেন্থলের পরিমাণের কারণে। মেন্থল এমন একটি উপাদান যা ত্বক এবং মুখের ঠান্ডা-সংবেদনশীল রিসেপ্টরগুলিকে সক্রিয় করে। যখন এই রিসেপ্টরগুলি সক্রিয় হয়, তখন তারা মস্তিষ্কে শীতল বোধ করার জন্য সংকেত পাঠায়, এমনকি যদি শরীরের প্রকৃত তাপমাত্রা পরিবর্তন না হয়। এই কারণে, গ্রীষ্মকালে পানীয়, চুইংগাম এবং মিষ্টিতে পুদিনা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
পুদিনার শীতলতা কেবল স্বাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। উদাহরণস্বরূপ, পুদিনা এবং কাঁচা আম দিয়ে তৈরি 'আম পানা' তাপ উপশমকারী একটি অত্যন্ত কার্যকর পানীয়। কাঁচা আম নিজেই একটি শীতল প্রভাব ফেলে কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে এবং এটি ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ করে। কাঁচা আমে পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ পদার্থও থাকে, যা শরীরে পানিশূন্যতা এবং পেশীর টান প্রতিরোধ করে। পুদিনা এবং কাঁচা আম একসাথে খেলে কেবল হজমশক্তিই উন্নত হয় না, বরং গ্রীষ্মকালে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও জোগায়।
মৌরি (Fennel - Foeniculum vulgare)
মৌরি হল শীতল প্রকৃতির একটি মশলা যা শতাব্দী ধরে ঐতিহ্যবাহী প্রতিকারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মৌরিতে 'অ্যানিথোল' নামক একটি অপরিহার্য তেল থাকে, যা শরীরের তাপ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, মৌরিতে উচ্চ পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা শরীরে জল শোষণ করে হাইড্রেশন বজায় রাখতে সাহায্য করে।
মৌরিতে ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ফেনোলিক যৌগের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও রয়েছে, যা শরীরকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে। মৌরি হজমের জন্যও খুবই উপকারী বলে মনে করা হয়। এটি গ্যাস, পেট ফাঁপা এবং বদহজমের মতো সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। মৌরিতে প্রদাহ-বিরোধী এবং ব্যাকটেরিয়া-প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যা শ্বাসনালী পরিষ্কার করতে এবং মাসিকের সময় খিঁচুনি কমাতে সাহায্য করে।
'ভার্যালি শরবত' বা 'মৌরি শরবত' গ্রীষ্মকালে গুজরাটে খুবই জনপ্রিয় একটি ঠান্ডা পানীয়। 'মুখোশ' অর্থাৎ খাবারের পরে খাওয়া মাউথ ফ্রেশনারেও মৌরির ব্যাপক ব্যবহার করা হয়। আপনি মৌরি পিষে সালাদে যোগ করতে পারেন অথবা শাকসবজি এবং তরকারিতে মিশিয়েও খেতে পারেন, যা খাবারের শীতলতা এবং স্বাদ উভয়ই বাড়ায়।
জিরা (জিরা - জিরা সিমিনাম)
জিরা একটি হালকা শীতল মশলা যা হজমশক্তি উন্নত করে এবং শরীরের তাপ ভারসাম্য বজায় রাখে। যদিও জিরাকে সাধারণত একটি গরম মশলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আয়ুর্বেদে এটি পিত্ত দোষের ভারসাম্য বজায় রাখে বলে বিশ্বাস করা হয়, যা শরীরের তাপ এবং প্রদাহের সাথে সম্পর্কিত। গ্যাস, বদহজম এবং অ্যাসিডিটির মতো হজমের সমস্যা দূর করতে জিরা খুবই কার্যকর, তাই গ্রীষ্মের খাদ্যতালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত বিকল্প।
জিরার শীতলতা বৃদ্ধির সুবিধাগুলি উপভোগ করার একটি সহজ উপায়: এক চা চামচ জিরা পানিতে ফুটিয়ে ঠান্ডা হতে দিন এবং সারা দিন অল্প অল্প করে পান করুন। এটি শরীরকে ঠান্ডা রাখে এবং হজমশক্তিও উন্নত করে। জিরা সবজি, ডাল, রায়তা বা বাটারমিল্কের সাথে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে, যা এগুলিকে আরও সুস্বাদু এবং শীতল করে তোলে। মধুর সাথে ভাজা জিরা মিশিয়ে খেলে শ্বাসকষ্ট, কফ এবং ঠান্ডা লাগা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
এলাচ (Elettaria এলাচ)
এলাচ একটি মিষ্টি এবং সুগন্ধযুক্ত মশলা যা খাবার এবং পানীয়তে স্বাদ এবং শীতলতা উভয়ই যোগ করার জন্য খুবই জনপ্রিয়। এটি শরীরকে বিষমুক্ত করতে সাহায্য করে অর্থাৎ ভেতর থেকে পরিষ্কার করে। গ্রীষ্মকালে প্রায়শই ঘটে যাওয়া সমস্ত সমস্যা যেমন বদহজম, বুক জ্বালাপোড়া এবং বমির মতো অনুভূতিতে এলাচ খুবই উপকারী।
আয়ুর্বেদে, এলাচকে 'ত্রিদোষিক' মশলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার অর্থ এটি তিনটি দোষ - বাত, পিত্ত এবং কফ - এর ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই এটি সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো বলে মনে করা হয়।
এলাচের শীতলতা বৃদ্ধির অর্থ হল এটি শ্বাসনালীর ফোলাভাব এবং জ্বালা কমায়, যার ফলে গলা ব্যথা, ঠান্ডা লাগা এবং নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটি সাধারণত চা, মিষ্টি এবং মাউথ ফ্রেশনারে যোগ করা হয়। এলাচ একটি বহুমুখী মশলা যা গ্রীষ্মে আপনাকে ঠান্ডা এবং সতেজ রাখতে সাহায্য করে।
ধনিয়া (ধনিয়া স্যাটিভাম)
ধনেপাতা বীজের শীতলকারী বৈশিষ্ট্যের জন্য আয়ুর্বেদে অত্যন্ত মূল্যবান। এটি শরীরের তাপ কমাতে সাহায্য করে, বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায়। ধনেপাতা 'পিত্ত দোষ'-এর ভারসাম্য বজায় রাখে এবং শরীরে শীতলতা এবং শিথিলতার অনুভূতি তৈরি করে, যার ফলে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। ধনেপাতা বীজ হজমশক্তি উন্নত করে বলেও জানা যায়। এগুলো হজম হরমোন সক্রিয় করে এবং পাকস্থলীর কার্যকারিতা উন্নত করে, গ্যাস এবং বদহজমের মতো সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
গ্রীষ্মকালে, ধনেপাতা পানিতে ভিজিয়ে ঠান্ডা পানি পান করা খুবই সতেজ পানীয়। এছাড়াও, ধনেপাতা প্রদাহ কমায়, অ্যালার্জি প্রতিরোধ করে, শরীরকে বিষমুক্ত করে, তৃষ্ণা নিবারণ করে, ত্বককে সুস্থ করে তোলে এবং অনিদ্রা ও উদ্বেগের মতো সমস্যা থেকেও মুক্তি দেয়।
উপসংহার:
তাপ বাড়ার সাথে সাথে শরীরকে স্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা করার প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পায়। এমন পরিস্থিতিতে, ভাতিভা (খুস), মেথি, পুদিনা, মৌরি, জিরা, ধনে এবং এলাচের মতো ভেষজ এবং মশলা খুবই উপকারী প্রমাণিত হয়। এগুলো কেবল শরীরকে ঠান্ডা রাখে না, বরং বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতাও প্রদান করে — যেমন হজমশক্তি উন্নত করা, প্রদাহ কমানো, হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা।
আপনি যদি আপনার প্রতিদিনের খাবার বা পানীয়তে এই শীতল ভেষজ এবং মশলাগুলি অন্তর্ভুক্ত করেন, তাহলে গ্রীষ্মে সতেজতা এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা খুব সহজ হয়ে যায়।
লেখক:- জ্যাক্স রাও, সিইও, রাজ্য ঔষধি উদ্ভিদ বোর্ড, ছত্তিশগড়, [আইএফএস (অবসরপ্রাপ্ত)]
Share your comments