একজন সাধারণ মানুষ এটাই মনে করেন যে, তারা দুবেলা যে শাকসবজী গ্রহণ করছেন, তা ভীষণ পুষ্টিকর ও খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ। কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বাজারে যে সবজীগুলির দেখা মেলে, সেগুলির প্রায় সবই বিষাক্ত। এটা পড়ে অবাক হচ্ছেন তো? কিন্তু এটাই রূঢ় বাস্তব। আর এর প্রধান কারণ হল বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক কৃষি বিষের (কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক) লাগাম ছাড়া ও মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ। এর কুপ্রভাব কি কেবলমাত্র সবজী বা অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্যের উপরই পরিলক্ষিত হচ্ছে? তেমনটা একদমই না। এর পাশাপাশি মাটির উর্বরা শক্তি ও বিভিন্ন পরাগযোগী উপকারী পতংগের (যেমন, মৌমাছি, ভ্রমর, বোলতা) সংখ্যাও আগের তুলনায় পাল্লা দিয়ে হ্রাস পেয়েছে। ফলস্বরূপ বিভিন্ন পতঙ্গ পরাগী (Entomophilous) কৃষিজ বা উদ্যানজাত ফসলের পরাগমিলন (Pollination) প্রভূত বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সবজী ফসলের মধ্যে শসা বা কুমড়োগোত্রীয় ফসল যেমন শসা, লাউ, উচ্ছে, কুমড়ো, ঝিঙ্গে, চালকুমড়ো, চিচিঙ্গা ইত্যাদিও তার ব্যতিক্রম নয়। খুব স্বভাবতই পরাগ যোগের সমস্যার কারণে গাছপ্রতি ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। অনেকক্ষেত্রে ফল ধরলেও ফলের আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে বা অসম্পূর্ণ পরাগমিলনের কারণে গাছে থাকা অবস্থাতেই অপরিণত ফল হলুদ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমাদের রাজ্য বা দেশ বলে নয়, সারা বিশ্বে এখন এই জাতীয় সবজী চাষের প্রধান অন্তরায় হল এই পরাগযোগী পতঙ্গের অপ্রতুলতা।
তাহলে কি সত্যিই কোন উপায় নেই ফলন বৃদ্ধির? এতটা আশাহত হওয়ারও কোন কারণ নেই। বিভিন্ন সবজী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আজকাল বিভিন্ন নতুন নতুন কৌশল বা প্রযুক্তির অবলম্বন করা হচ্ছে। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, সেগুলি বেশ খরচসাপেক্ষ, যা একজন সাধারণ ও প্রান্তিক চাষীর পক্ষে সবসময় প্রয়োগ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আর তাই এসব কথা মাথায় রেখেই আজ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ‘৩ জি কাটিং’। প্রধানত এটি কুমড়োগোত্রীয় ফসলের ফলন বৃদ্ধির সহজতম পন্থা। সবচেয়ে বড় কথা হল, একজন কৃষকবন্ধু বিনা কোন খরচেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সাধারণ অবস্থার তুলনায় ১০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত অধিক ফলন আশা করতে পারেন।
কি এই ‘৩ জি কাটিং’ –
‘৩ জি’ (3G) কথাটির ইংরাজিতে আক্ষরিক অর্থ হল ‘Third Generation’, যার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় ‘তৃতীয় প্রজন্ম’। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে কীসের ‘তৃতীয় প্রজন্ম’? সহজ উত্তর হল গাছের শাখা প্রশাখার। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বোঝা দরকার। বীজের অঙ্কুরোদগমের পর, যে কোন গাছের যে প্রাথমিক শাখাটির (Primary branches) জন্ম হয় এবং বৃদ্ধি ও বিকাশ চলতে থাকে, তাকে ‘১ জি’ (First Generation) অর্থাৎ প্রথম প্রজন্মের বা প্রথম বর্গীয় শাখা বলা হয়। প্রাথমিক শাখা থেকে পরবর্তীতে ‘২ জি’ (Second Generation) অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজন্মের শাখা প্রশাখা (Secondary branches) ও ২ জি শাখা প্রশাখা থেকে ‘৩ জি (Third Generation) অর্থাৎ তৃতীয় বর্গীয় (Tertiary branches) শাখা প্রশাখার জন্ম হয়।
‘৩ জি’ কাটিং নামটি শুনেই হয়তো মনে হতেই পারে যে, এটি অভিনব একটি কৌশল। আদতে ব্যাপারটা কিন্তু তেমন না। এটি মূলত যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে, তা হল শাখার অগ্রস্থিত বা শীর্ষস্থ অংশের ছাঁটাই (Pinching of apical portion of branches), যা বহুদিন ধরেই কৃষকবন্ধুরা বিভিন্ন ফসলে চর্চা করে আসছেন।
‘৩ জি’ কাটিং করব কেন ?
কুমড়োগোত্রীয় ফসলের ‘১ জি’ ও ‘২ জি’ (অর্থাৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শাখা প্রশাখাগুলিতে পুরুষ ফুলের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে দেখা গেছে স্ত্রী ও পুরুষ ফুলের অনুপাত ১৪ : ১। আরও সহজভাবে বললে, ১৪ টি পুরুষ ফুল ফুটলে তার পরিপ্রেক্ষিতে ১ টি স্ত্রী ফুল জন্মায়। শতাংশের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, পুরুষ ফুল প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ ও স্ত্রী ফুল ১০-১৫ শতাংশ। কিন্তু আমরা সকলেই জানি, পুরুষ ফুল থেকে ফল সৃষ্টি হয় না। তাই আপাতদৃষ্টিতে গাছ ফুলে পরিপূর্ণ বলে মনে হলেও গাছপ্রতি ফলন হয় অত্যন্ত কম। অন্যদিকে তৃতীয় প্রজন্মের শাখা প্রশাখাগুলিতে অধিক সংখ্যায় স্ত্রী ফুলের দেখা মেলে। সে কারণেই একটি গাছে, তৃতীয় প্রজন্মের (3G) প্রশাখা কিভাবে অধিক সংখ্যায় বিকশিত করানো যায়, কৃষকবন্ধুদের সে বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা উচিৎ। তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে পুরুষ ও স্ত্রী ফুলের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য এনে, কৃত্রিম পরাগায়নের মাধ্যমে গাছ প্রতি ফলন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
নিবন্ধ - শুভ্রজ্যোতি চ্যাটার্জ্জী এবং দেবমালা মুখার্জি (গবেষক, সবজী বিজ্ঞান বিভাগ, উদ্যান পালন অনুষদ, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মোহনপুর, নদীয়া)
Image source - Google
Related link - (Wheat variety) গমের রোগ প্রতিরোধী এই জাতের বপণে কৃষকরা পাবেন সর্বাধিক ফলন
(Pulse cultivation) ডালের নতুন দুই প্রজাতির আবিষ্কার – কৃষক হবেন দ্বিগুণ লাভবান
Share your comments