পান (Betel leaf farming) বহুবর্ষজীবী অর্থকরী ফসল | সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮ কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পানের চাষ হয়। আর ভারতবর্ষে পানের উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ হয় পশ্চিবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৯০০০ হাজার হেক্টর এলাকায় পানের চাষ হয়। সাধারণত বাঁশ, কাঠ, খড়, দড়ি ইত্যাদি দিয়ে যে বরজ তৈরী করা হয় তা ২ - ৩ বছর খুব একটা মেরামত করার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু বাঁশ, কাঠ প্রায় প্রতি বছরই পাল্টাতে হয়। তাছাড়াও এর জন্য দক্ষ শ্রমিক লাগে ফলে খরচ বাড়তে থাকে। বর্ষার সময় রোগবালাই সমস্যা দেখা দেয় |
শেড নেট কি(What is shade net)?
শেড নেট ব্যবহার করে আধুনিক পদ্ধতিতে পান চাষ করে কৃষকরা আর্থিক দিক থেকে লাভবান হচ্ছেন | এবং কম খরচের বাঁশের কাঠামোর ওপর শেডনেটের আচ্ছাদন করে সহজেই পান চাষ করা যায় | শেড নেটের এই উন্নত বরজে পান গাছের মাথার ওপরে বিছানো থাকে স্প্রিঙ্কলারের ল্যাটেরাল পাইপ যার সাহায্যে সেচ দেওয়ার সাথে সাথে তরল সার ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা যায়। এরফলে পানের গুণমান ও বাজারদর ভালো পাওয়া যায়। শেডনেটের বরজে উন্নত সেচ ব্যবস্থা থাকায় গাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ও শস্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান সম্মত পদক্ষেপ নিতে সুবিধা থাকায় বার্ষিক লাভের পরিমান ৪ - ৫ গুণ বেশি পাওয়া যায়। আবার বাঁশের বদলে লোহার স্ট্রাকচার তৈরি করে শেডনেটের আচ্ছাদন দিলে ঝড় বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।
শেড নেটে পান চাষের সুবিধা(Benefits of shade net):
১) প্রাথমিক খরচ বেশি, কিন্তু এই পন্থা বেশি লাভজনক |
২) ঋতুভিত্তিক বরজ মেরামতির প্রয়োজন নেই।
৩) ঝড়, বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির সম্ভাবনা কম |
৪) রোগ পোকার উপদ্রব কম।
৫) বর্তমানে, শেড নেট পদ্ধতিতে পান চাষে সরকার থেকে ভর্তুকি পাচ্ছেন চাষীভাইরা |
৬) মাইক্রো ইরিগেশন পদ্ধতিতে সেচ প্রদান উৎকৃষ্ট গুণমানের পাতা উৎপাদন করে |
৭) বরজের মধ্যে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করে, যা পানের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক |
আরও পড়ুন -Groundnut Farming: অর্থকরী ফসল চীনাবাদাম চাষের সহজ পদ্ধতি
নতুন বরজ তৈরি:
নির্বাচিত জমির মাটি ভালো ভাবে লাঙল দিয়ে তার পর ভিজিয়ে দিতে হবে। এর পর চৈত্র – বৈশাখ মাসে ওই কর্ষিত জমি ১ মাস ধরে রৌদ্র খাওয়াতে হবে। এ জন্য সাদা পলিথিন চাদরে জমি ঢেকে দিতে হবে। সপ্তাহের ১ দিন বিকেলে পলিথিন চাদর খুলে জমিতে অল্প জল ছিটিয়ে আবার ঢেকে দিতে হবে। এর পর ৬০ মিলি ফরম্যালিন ১০ লিটার জলে গুলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে প্রয়োগ করে পলিথিন চাদরে আরও ৪ – ৫ দিন ঢেকে রাখতে হবে। এর ২৫ – ৩০ দিন পর ওই জমিতে লতা লাগাতে হবে।
সার প্রয়োগ(Fertilizer):
নতুন বরজে লতা বসানোর কয়েক দিন আগে প্রতি কাঠায় মোট ৬ কেজি হিসাবে আধাআধি নিম ও বাদাম খোল মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ মাসের মধ্যে গাঁট থেকে নতুন চারা বের হয়। চারা বের হলে মাটি ধরতে হবে এবং প্রতিটি লতার পাশে একটি করে সরকাঠি পুঁতে লতাটি কুশখড় দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। লতা যেমন লম্বা হবে তেমন ভাবে মাসে ৩ – ৪ বার পাট বা সরকাঠিতে বেঁধে দিতে হবে। ৬ – ৮ মাসের মধ্যে লতাটি প্রায় ২ মিটারের মতো লম্বা হয়ে যাবে। তখন তাকে উপরের দিকে বাড়তে না দিয়ে নীচের দিকে পাশিয়ে দিতে হবে ও কাওটি মাটি চাপা দিতে হবে। এই কাজটি বাংলা ও সাঁচি জাতের পানের ক্ষেত্রে বছরে ৫ – ৬ বার আর মিঠা জাতের পানের ক্ষেত্রে ৩ – ৪ বার করতে হয়। বর্ষাকালে সাধারণত লতার বাড় বেশি হয় | পানের বরজে সাধারণত বছরে ৪ থেকে ৫ বার সার ব্যবহার করা হয় এবং জৈব সার বেশি পরিমাণ ব্যবহার হয়। সাধারণত বৈশাখ, আষাঢ়, ভাদ্র, কার্তিক ও পৌষ মাসে সার ব্যবহার করা হয়। ৫ কাঠা বরজের জন্য প্রতি বছরে ১০০ কেজি খোল, ৮ কেজি ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সার, ১৫ কেজি মি. সুপার ফসফেট ও ১৬ কেজি মিউরেট অফ পটাশ ৬ ভাগে ভাগ করে প্রতি ২ মাস অন্তর প্রয়োগ করতে হবে।
রোগ ও প্রতিকার(Disease management system):
গোড়া পচা ও পাতা পচা -
ছত্রাকঘটিত এই রোগের আক্রমণের ফলে আক্রান্ত পাতাগুলো কিছুটা কম উজ্জ্বল ও নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আর মাটির সংলগ্ন কাণ্ডে ২ টো গাঁটের মাঝে মাঝে কালো দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত ডাঁটা পচে যায় এবং ডাঁটার ওপরের অংশ ঢলে পড়ে শুকিয়ে যায়। গাছের নীচের দিকের পাতাগুলি বেশি আক্রান্ত হয়। আর বর্ষাকালীন সময়ে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
প্রতিকার -
বর্ষাকালে প্রতি মাসে ১ বার ১% বোর্দো মিশ্রণ দিয়ে গাছের গোড়া ভিজিয়ে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া, কপার অক্সিক্লোরাইড (৪ গ্রাম) বা ০.৫% বোর্দো মিশ্রণ ১৫ দিন অন্তর পাতার নীচের দিকে স্প্রে করতে হবে।
পাতায় দাগ ধরা রোগ -
পাতায় কালো বা বাদামি রঙের অসংখ্য দাগ দেখা যায়। লতার নীচের দিকের পাতায় প্রথমে দেখা যায় পরে উপরের পাতাও আক্রান্ত হয়। দাগগুলি ঘিরে থাকে হলুদ আভা। অপেক্ষাকৃত গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এই রোগ লতার কাণ্ডে আক্রমণ করে থাকে। কাণ্ডের সবুজ ত্বকের নীচে গোলাকার ছোট দাগ পড়ে। সাধারণত বর্ষার প্রারম্ভে বা শেষে এই রোগের প্রকোপ বাড়ে।
প্রতিকার:
প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসাবে বর্ষা শুরুর আগে কপার অক্সিক্লোরাইড ৪ গ্রাম / লিটার বা ০.৫% বোর্দো মিশ্রণ জলে গুলে ডাঁটায় ও পাতায় ভালো ভাবে স্প্রে করতে হবে। ২০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - Ginger Farming: আদা চাষে লাভ পেতে চাষ করুন এই পদ্ধতিতে
Share your comments