পশ্চিমবঙ্গই (West Bengal) একমাত্র রাজ্য যেখানে রাবি এবং খারিফ উভয় মরসুমেই (Kharif Season Farming) তিন ধরণের ধানের চাষ হয়। আউশ, আমন, বোরো, তুলাইপাঞ্জি বিভিন্ন ধরণের ধান উৎপাদিত হয় এখানে। বাংলায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত এবং ভাল জলবায়ু উচ্চমানের ধান উৎপাদনে বিশেষ সহায়ক। বাংলার উচ্চ মানের ধানের চাহিদা প্রায় সকল অঞ্চলে রয়েছে এবং এমনকি এখান থেকে তা বিদেশেও রফতানি হয়।
ধান চাষের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে ধানচাষকে লাভজনক করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সঠিক বীজতলার মাধ্যমে সুস্থ সবল এবং অপেক্ষাকৃত মোটা চারা তৈরী করা। কিন্তু সাধারণতঃ কৃষকবন্ধুরা চিরাচরিত পদ্ধতিতে যেভাবে চারা তৈরি করেন তাতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
১) অল্প জায়গাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী বীজ ফেলে অত্যন্ত ঘন করে বোনা হয় ফলে বীজতলায় চারার বৃদ্ধি ভীষণ ভাবে ব্যাহত হয়। অনেকেরই ধারণা চারা ঘন করে ফেললে আগাছা হবে না, আবার কেউ কেউ মনে করেন চারা সরু হলে তুলতে ও রোয়া করতে সুবিধা হয় আর এসব ভাবতে গিয়েই আমরা সরু দুর্বল চারা তৈরী করে ফেলি যা একদম অনুচিৎ।
২) চারা অত্যন্ত সরু হবার জন্য গুছিতে ৫-৬ চারা দিয়ে রোপন করা হয়। ফলে গুছির ভেতরে প্রতিযোগীতা বেশি হয় এবং তাতে পাশকঠির বৃদ্ধি যেমন অসম হয় আবার অনেক বন্ধ্যা পাশকাঠিও জন্মায়।
৩) অনেকক্ষেত্রেই চারাতে শিকড় কম থাকায় চারার বর্ধনশীল অংশ মাটির গভীরে পুঁততে বাধ্য হন যাতে চারা ভেসে না থাকে কিন্তু এর ফলে চারার বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
৪) ঘন করে বীজতলা করার ফলে চারাতে সঞ্চিত পুষ্টি ও শক্তি কম থাকায় মূল জমিতে চারা প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক সময় নেয়, সেসময় আগাছার উপদ্রব বাড়ে।
৫) এছাড়াও চারার আভ্যন্তরীণ শক্তি কম থাকার কারনে সহজেই খরা-বন্যা ও রোগ-পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয় ।
৬) অতিরিক্ত ঘন হওয়ায় বীজতলার সুক্ষ আবহাওয়া রোগ–পোকার আদর্শ হয়ে ওঠে, ফলে চারাতে রোগ–পোকার আক্রমণও অনেক বেশী হয়, পরে যা মূল জমিতে ছড়িয়ে পড়ে।
সুস্থ সবল চারা তৈরী করতে যে যে বিষয়গুলির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা আমরা ক্রমপর্যায়ে আলোচনা করব। কিন্তু প্রধানত যে দুটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, তা হল –
বীজ বপনের নিয়ম (Seed sowing process) -
প্রথমত : বীজতলাতে চারা যাতে পর্যাপ্ত পরিমানে আলো বাতাস পায় তার জন্য উপযুক্ত জায়গা দিতে হবে অর্থাৎ একটু ফাঁকা ফাঁকা বীজ ফেলতে হবে আর
দ্বিতীয়ত : চারাতে যেন যথেষ্ট পরিমান সঞ্চিত খাদ্য / শক্তি ও বৃদ্ধি সহায়ক হরমোন থাকে, চারার যেন বয়স বেশী না হয় এবং বীজতলাতে যেন কোনরকম গাঁট না আসে। তাই ভালো ফলনের জন্য আমাদের একদম শুরু থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল ভালো বীজতলা তৈরী করা। আর তার জন্য চাই উপযুক্ত জায়গা ও ভালো মাটি যা জৈব উপাদানে ভরপুর।
আমন মরসুমে বীজতলা কাদা ও শুকনো দুভাবেই করা যায়। যে সব এলাকায় সেচের সুবিধা নেই বা কাদা বীজতলার জন্য পর্যাপ্ত বৃষ্টির জল পাওয়া যায় না, আবার হঠাৎ দু - এক দিনের বৃষ্টিতে বেশ খানিকটা জল দাঁড়িয়ে যায় সেখানে শুকনো বীজতলা খুব সহজেই করা যায়। এই বীজ তলার চারা কাদা বীজতলার চেয়ে শক্ত হয় এবং প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করতে পারে। যদিও এই বীজতলা তৈরীতে বেশি ধান ও বেশী সময় লাগে। আর সেচ এলাকায় বা যেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয় সেখানে অল্পসময়ে কাদা বীজতলা করা হয়।
বীজতলার মাটির শোধন (Seedbed soil treatment) -
ভালো চারা তৈরীর জন্য বীজতলার মাটির শোধন করা বিশেষ জরুরী। সেক্ষেত্রে ফর্মালিন সলিউশন ( ১.৫-২.০ % ) প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৪-৫ লিটার বীজ বোনার ১৫-২০ দিন আগে স্প্রে করে এক সপ্তাহের জন্য পলিথিন ঢেকে রাখতে হবে। অথবা বীজতলা শোধনের জন্য রোয়ার ৮-১০ দিন আগে প্রতি কাঠা বীজ তলার জন্য ১০০ গ্রাম ফোরেট বা ৩০০ গ্রাম কার্বফুরান প্রয়োগ করে ৫ সেন্টিমিটার মত জল ধরে রাখা হয়। আবার দানাদার ওষুধ প্রয়োগ না করা গেলে রোয়ার ৩ দিন আগে ডিমেক্রন ১.৫ মিলি অথবা রিজেন্ট ১ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করা হয়। কতটা জায়গায় কতটা বীজ ফেলবেন ভালো চারার জন্য এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত যতটা জমি চাষ করা হয় তার ১১০ অংশ জমিতে বীজতলা করা উচিৎ। যদিও বেশ যত্ন সহকারে বীজতলা করলে ১/৫ অংশতেও ভালো চারা তৈরী সম্ভব । জৈষ্ঠ্য মাসে শুকনো বীজ তলা এবং জৈষ্ঠ্য - আষাড় মাসে কাদা বীজতলা তৈরী করা হয় । শুকনো বীজতলায় সরু ধান ৪-৫ কেজি, মাঝারি ধান ৬-৭ কেজি আর মোটা ধান প্রায় ৭-৮ কেজি বোনা হয়, কাদা বীজতলাতে অবশ্য কিছুটা কম বীজ লাগে ।
সুষম সারের সরবরাহ (Supply of balanced fertilizer) -
আদর্শ বীজতলাতে ভালো চারা তৈরী করার জন্য সুষম সারের সরবরাহ একান্ত জরুরী । সাধারণভাবে বীজতলার মূল সার হল জৈবসার । বীজতলায় জৈবসার কিন্তু অবশ্যই দিতে হবে । জৈবসার খাদ্য উপাদান সরবরাহের সাথে সাথে মাটি যেমন হালকা করে। বীজতলা তৈরীর সময় প্রতি কাঠার জন্য ১০০ কেজি পচা জৈব সার ১ সপ্তাহ আগে মিশিয়ে লাঙল দিয়ে মই দিতে হবে ।
যদি শুকনো বীজ তলা করেন সেক্ষেত্রে কাঠা প্রতি ১.৫ কেজি ইউরিয়া + ২ কেজি এসএসপি + ৫০০ গ্রাম এমওপি প্রয়োগ করুন। জমিতে রস না থাকলে নাইট্রোজেন প্রথমে প্রয়োগ না করে রোয়ার ৮-১০ দিন আগে বীজতলায় দিন। আর কাদা বীজ তলার ক্ষেত্রে জমি তৈরীর সময় শেষ চাষে কাঠা প্রতি ৭৫০ গ্রাম ইউরিয়া ২ কেজি এসএসপি + ৫০০ গ্রাম এম ও পি প্রয়োগ করুন।
বীজ বোনার জমি মোটামুটি উর্বর হলে দেশী ও সুগন্ধী ধানের ক্ষেত্রে বীজতলায় জৈবসার ব্যতীত আর কোন সার তেমন প্রয়োজন হয় না। খেয়াল রাখতে হবে অঙ্কুরিত চারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হল ফসফেট। ফসফেট প্রয়োগে চারায় প্রচুর শিকড় তৈরী হয়, বৃদ্ধি ভালো হয় ও তাড়াতাড়ি পাশকাঠি আসে । সেই সঙ্গে চারায় যাতে সালফার ও কালশিয়ামের ঘাটতি না আসে সেই জন্য ফসফেট হিসাবে অবশ্যই সিঙ্গেল সুপার ফসফেট ব্যবহার করতে হবে।
ধানের প্রধান অনুখাদ্য হল জিংক। অঙ্কুর বেড়ানোর সময় থেকেই ধানে জিংক লাগে, তাই প্রতি লিটার জলে ০.৫ গ্রাম চিলেটেড জিংক অথবা ২.৫ গ্রাম জিংক সালফেট প্রতি বর্গমিটারে বীজতলা তৈরীর সময় দিতে হবে।
আরও পড়ুন - Kharif Onion Farming - খারিফ মরসুমে এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ থেকে আয় করুন অতিরিক্ত অর্থ
মনে রাখবেন, পরিচর্যার সুবিধার জন্য জমি তৈরীর পর বীজতলাকে ১.৫ মিটার চওড়া ও সুবিধামত লম্বা ছোট ছোট বেডে ভাগ করে নিতে হবে । দুটি বেডের মাঝে ৩০ সেমি চওড়া ও ১৫ সেমি গভীর হাতনালা থাকা প্রয়োজন। এর পর ধান পাতলা করে ছিটিয়ে বুনতে হবে। গাছ হলুদ হয়ে গেলে বা চারা বসে গেলে অ্যামাইনো অ্যাসিড ২ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে তার ৬-৭ দিন পর বোরন এবং জিংক সমৃদ্ধ যে কোন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট মিক্সচার ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
আরও পড়ুন - Paddy Seed Purification - ধানের ভালো ফলনের জন্য বীজ শোধনের পদ্ধতি
Share your comments