পান চাষ এক বিশেষ রকমের কাঠামোতে হয়ে থাকে যা ‘বরজ’ নামে পরিচিত। এই বরজ হল ভালো ভাবে ঘেরা ও উপরে ছাউনি দেওয়া বিশেষ ভাবে প্রস্তুত একটি ঘর। আর এই ছায়া ঘন পরিবেশের মধ্যে পানের চাষ যথেষ্ট সংখ্যায় ও উপযুক্ত মানের হয়। তবে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলা সহ অসম, উত্তর-পূর্ব ভারতে সাধারণ ভাবে সুপারি গাছকে অবলম্বন করে বরজ ছাড়াই পান চাষ করা হয়ে থাকে।
পানের ভালো বাজার মধ্য প্রাচ্য সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে রয়েছে এবং আমাদের রাজ্য সহ দেশের অন্যান্য রাজ্য থেকে ওই সমস্ত দেশে রফতানি হয়।
মাটি ও জলবায়ু -
সাধারণত যে কোনও মাটিতেই পান চাষ হতে পারে। তবে উঁচু জলনিকাশিযু্ক্ত দোঁয়াশ বা এঁটেল-দোঁয়াশ মাটি পান চাষের উপযুক্ত। জমির পি.এইচ. ৭.০-৮.০-এর মধ্যে থাকা দরকার। তবে সেচের সুব্যবস্থা আছে এমন বেলে বা দোঁয়াশ মাটিতেও পান চাষ করা যেতে পারে। নোনা বা ক্ষার জাতীয় মাটি পান চাষের অনুপযুক্ত। ছায়াযুক্ত আর্দ্র বা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া ও রসযুক্ত মাটি পান চাষের উপযুক্ত। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৫০-১৭৫ সেমি এবং ১০-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পানের জন্য আদর্শ।
সাধারণত একটি বরজ থেকে ৮-১০ বছর ধরে পানের ভালো ফলন পাওয়া যায়, যদি না প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কারণে বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মিঠা পানের জন্য দোঁয়াশ মাটি আর বাংলা ও সাঁচি পানের জন্য এঁটেল-দোঁয়াশ মাটিই সর্বোৎকৃষ্ট। পানের গুণগত মান ও ফলনের সাথে মাটির তারতম্য সরাসরি যুক্ত।
জাত -
গাছ-পানের ক্ষেত্রে পানের লতাকে বাড়তে দেওয়া হয়। সাধারণত বছরে ৩-৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। গাছ-পান অন্য গাছকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে। এই পানের পাতা মোটা ও ফলকটি (লিফ ব্লেড) সংকীর্ণ ও কটু স্বাদযুক্ত হয়। এ ছাড়া বরজে নিম্ন প্রকার জাতের চাষ করা হয়।
বাংলা পান -
সব থেকে বেশি এই জাতের চাষ হয়। এই জাতের পাতার ফলক বড়, পাতলা, গোলাকার ও পাতার অগ্রভাগ ছোট। ফলন তুলনামূলক বেশি এবং স্বাদও ভালো। বেশিরভাগ বরজে বাংলা জাতের ঘনঘেঁটে, কালী, গয়াশী (গয়াসুর) প্রভৃতি পানের চাষ হয়।
সাঁচি পান -
এই জাতটির পাতা ছোট, পাতলা, নরম ও ডিম্বাকৃতি, পাতার বোঁটা ছোট এবং পাতার ডগা ক্রমশ ছুঁচোলো। বাংলা জাতের থেকে এই জাতটির ফলন কম। স্বাদ ঝাল ও কটু।
মিঠা পান –
হাওড়া ও মেদিনীপুর ছাড়াও নদিয়া জেলায় এই জাতটির চাষ হয়। এই জাতটির পাতা ছোট, মোটা, নরম ও লম্বাটে। পাতার বোঁটা ছোট ও পাতার ডগা ক্রমশ সরু। শাখা-প্রশাখা হয়, তবে লতার বৃদ্ধি হার অপেক্ষাকৃত কম। লতা অত্যন্ত সংবেদনশীল, ফলন তুলনামূলক ভাবে উপরোক্ত দু’টি জাত থেকে কম। স্বাদ মিষ্টি ও সুস্বাদু।
জমি তৈরি ও মাটি শোধন (Soil preparation) -
নতুন পান বরজ তৈরি করার জন্য নির্বাচিত জমির মাটি ভালো ভাবে ৪-৫ বার চাষ দিয়ে তারপর ভিজিয়ে দিতে হবে। জমি চাষ করার সময় প্রতি কাঠা এলাকা জমির জন্য ১০০ কেজি গোবর সার, ৩ কেজি বাদাম খোল ও ৩ কেজি নিমখোল মেশাতে হবে। এর পর চৈত্র-বৈশাখ মাসে ঐ কর্ষিত জমি ১ মাস ধরে রোদ খাওয়াতে হবে ও জমিকে সাদা পলিথিন চাদরে ঢেকে দিতে হবে। সপ্তাহে এক দিন বিকেলে পলিথিন চাদর খুলে জমিতে অল্প জল ছিটিয়ে আবার ঢেকে দিতে হবে। এরপর ৬০ মিলি ফরম্যালিন ১০ লিটার জলে গুলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে প্রয়োগ করে পলিথিন চাদরে আরও ৪-৫ দিন ঢেকে রাখতে হবে। এর একমাস পর ঐ জমিতে পানের বীচন লাগাতে হবে।
আরও পড়ুন - জানুন সঠিক নিয়মে বনসাই তৈরির পদ্ধতি (Make Bonsai)
বরজের উচ্চতা ও ছাউনি -
কৃত্রিম ছায়াঘেরা জায়গায় বরজ তৈরি করার জন্য বাঁশ, বাঁশের কাঠি, পাটকাঠি, গাছের ডাল, সুপারি, খেজুর, নারকেল গাছের পাতা, কুশ, উলুখড় ইত্যাদি স্থানীয় সহজলভ্য দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। বরজের আকার বর্গাকার বা আয়তাকার যাই হোক না কেন, এর উচ্চতা ২ মিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়, তাতে পরিচর্যার সুবিধা হয়। অতিরিক্ত ঘন ছাউনি বাঞ্ছনীয় নয়। এ ছাড়া বর্ষাকালে ছাউনি পাতলা ও শীতকালে ছাউনি ঘন করে দিতে হবে।
বীচন লাগানোর সময় -
আষাঢ় ও আশ্বিন–কার্তিক মাস উপযুক্ত। তবে আশ্বিন–কার্তিক মাসে লাগালে ফলন ভালো পাওয়া যায়। এক একটি গাছাতে ৮০-৯০টি এক গাঁট যুক্ত কাটিং বা বীচন প্রয়োজন হয় অর্থাৎ বিঘা প্রতি ১৬০০০-১৮০০০ টি কাটিং-এর প্রয়োজন।
বীচন সংগ্রহ -
সতেজ, রোগমুক্ত ৪-৫ বছরের পুরনো বরজ থেকে লতা সংগ্রহ করা প্রয়োজন। লতার গোড়ার দিকের এক হাত/দেড় হাত বাদ দিয়ে গাঁট বীজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বীচন সংগ্রহের একমাস আগে বরজে ১৫ দিন অন্তর দুবার ০.৫% কপার অক্সিক্লোরাইড বা ০.৩% ম্যানকোজেব স্প্রে করতে হবে। বীচন সংগ্রহের ৫-৬ দিন আগে গাছের ডগা ২-৩ সেমি ভেঙে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এর পর লতা থেকে বীচন কাটার জন্য জীবাণুমুক্ত ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে।
বীচন শোধন -
মাটিতে লাগাবার আগে বীচনগুলো ০.৫% ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি অথবা ০.৫% কপার অক্সিক্লোরাইড এবং স্ট্রেপটোসাইক্লিন দ্রবণে (১গ্রাম/৪ লিটার জলে) ডুবিয়ে শোধন করে নিতে হবে। বীচনগুলো ছায়াতে শুকিয়ে পিলি বা সারি বরাবর মাটিতে লাগাতে হবে। রোপণের আগে বীচনের গোড়ায় শিকড় গজানো হরমোন পাউডার লাগালে দ্রুত শিকড় বেরোয়।
বীচন রোপণ -
সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০-৬০ সেমি এবং প্রতি সারিতে দু'টি বীচনের মধ্যে ১০-১৫ সেমি দূরত্ব রাখতে হবে। বীচন লাগানোর অন্তত সাতদিন আগে সারির মাটি ১% কপার অক্সিক্লোরাইড দ্রবণ দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।
আরও পড়ুন - পান চাষে রোগের আক্রমণ ও তার প্রতিকার (Disease of betel vine)
Share your comments