মৌরী (Fennel seed) আমাদের কাছে খুবই প্রিয় একটি মসলা। মৌরীর ফল বা বীজ মসলা, পান মসলা, মুখশুদ্ধি ইত্যাদিতে, এবং পাতা ও নরম কান্ড সস্ তৈরিতে, সালাদ হিসাবে, এবং শেকড় আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
মৌরির জাত (Variety) :
মৌরির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জাত- কো-১, এস-৭, পি এফ-৩৫ ইত্যাদি।
আসুন জেনে নেই মৌরি চাষের পদ্ধতি (Cultivation Process) :
মৌরি চাষে মাটি:
মৌরি চাষের জন্য বেলে, বেলে দো-আঁশ মাটি উত্তম। তবে জমিটা একটু উঁচু সুনিষ্কাশিত হলে ভাল হয়।
মৌরি চাষের সময়:
মৌরি চাষের জন্য বীজ বোনার উপযুক্ত সময় অক্টোবর–নভেম্বর মাস পর্যন্ত।
মৌরি চাষে বীজের হার:
ছিটিয়ে বুনলে প্রতি হেক্টরে ৯-১২ কেজি, সারিতে বুনলে ৭-৯ কেজি এবং নার্সারিতে চারা তৈরি করে লাগালে ৩-৪ কেজি বীজের প্রয়োজন হতে পারে।
মৌরি চাষে জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ:
মৌরি চাষের জমি ৪-৫টি গভীরভাবে ভাল করে চাষ দিতে হবে। প্রথম চাষের সময় জমিতে হেক্টর প্রতি ১০ টন জৈব সার বা খামারের সার দিতে হবে। শেষ চাষের আগে রাসায়নিক সার হিসাবে ৩০ কেজি নাইট্রোজেন, ৪০ কেজি ফসফেট ও ২০ কেজি পটাশ সার দিতে হবে। উঁই, পিঁপড়া ইত্যাদির আক্রমনের সম্ভাবনা থাকলে বীজ বোনার আগে প্রতি হেক্টরে ২৫ কেজি এন্ডোসালফান গুঁড়ো প্রয়োগ করতে হবে। জমির উর্বর শক্তি কম হলে ৩০ কেজি নাইট্রোজেন, ৬০ কেজি ফসফরাস ও ৩০ কেজি পটাশ মূল সার হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে। চাপান সার হিসাবে ৩০ কেজি করে নাইট্রোজেন প্রতিবারে বীজ বোনার ১মাস ও ২মাস পরে প্রয়োগ করতে হবে এবং সার প্রয়োগের পর পরই হালকা করে সেচ দেওয়া উচিত।
মৌরি চাষে পরিচর্যা ও সেচ ব্যবস্থা:
বীজ বোনার ২০-৩০ দিনের মাথায় নিড়ানি দিয়ে আগাছা মুক্ত করতে হবে, অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে ও গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে। প্রয়োজনে ১৫-২০ দিন পর পর আরও দুই তিনবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। মাটির অবস্থা ও গুণাগুণ দেখে জমিতে সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে ১৫-২০ দিন পরপর হালকা সেচ দিতে হবে।
মৌরি চাষে রোগ ও পোকা দমন -
জাবপোকা,চোষীপোকা, বিটল,গলমীজ ইত্যাদি কীটশত্রু এবং ধ্বসা, সাদাগুঁড়ো, ঝিমিয়ে পড়া ইত্যাদি রোগ দ্বারা মৌরি গাছ আক্রান্ত হয়ে থাকে।
১. মৌরি চাষে জাবপোকা -
পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ জাবপোকা পাতা, ফুল ও কচি ফল থেকে রস শোষণ করে, মধুবিন্দু ক্ষরণ করে ফলে,শুটিং মোল্ড রোগ দেখা যায়। বোনার সময় পাল্টে ও আর.সি-৭৮, আর.সি-৯ জাতীয় প্রতিরোধী জাত চাষ করে এ জাতীয় জাব পোকার আক্রমণ কমানো যেতে পারে।
২. মৌরি চাষে চোষী পোকা -
পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ চোষীপোকা কান্ড ও পত্রবেষ্ঠনীর মাঝখানে দল বেঁধে বাস করে ও রস শোষণ করে। আক্রান্ত পাতা ও ফুল শুকিয়ে যায় ও নিম্নমানের কুঞ্চিত, বিকৃত ফল হয়ে থাকে।
মৌরি চাষে প্রতিকার -
চোষীপোকা নিয়ন্ত্রনের জন্য ০.২% কার্বারিল বা ০.২% ডাইমিথয়েট বা ০.১% ডায়াজিনোন বা ০.১% ফেনিট্রোথিয়ন বা ০.২% এন্ডোসালফান স্প্রে করলে ভাল হয়।
৩. মৌরি চাষে বীটলপোকা -
এ পোকা পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ দশা ফল ও বীজ খেয়ে নষ্ট করে। সংরক্ষণের সময় এই পোকার দ্বারা বীজ বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে।
মৌরি চাষে প্রতিকার -
গুদামের বীজ ৬৪ মিগ্রা/ঘন মিটার ইথিলিন ডাইব্রোমাইড দ্বারা ৬ দিন ধরে ধূমায়িত করে এ পোকা নিয়ন্ত্রন করতে হবে। বীজের সাথে লস্কার গুঁড়ো বা হলুদ গুঁড়ো প্রতি কেজি বীজে ১-২ গ্রাম হিসাবে ভাল করে মিশিয়ে রোদে শুকানো বীজ ৪-৬ মাস সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন - জানুন বিদেশী ফল কিউয়ি এর চাষ কৌশল
৪. মৌরি চাষে ধ্বসা রোগ -
বীজ বোনার ৬০-৭০ দিন পরে পরিণত পাতার নিচের দিকে ছোট ছোট তিনকোনা, উঁচু নিচু দাগ দেখা যায়। পরে ঐ এলাকায় সাদাটে ধরনের উঁচু নিচু দাগ দেখা যায়। ক্রমে কান্ড, পুষ্পদন্ড ও ফলে ছড়িয়ে পড়ে। পরে, পাতা কুঁকড়ে যায় ও ধ্বসা ধরা হয়ে শুকিয়ে যায়। প্রথম দিকে আক্রমন হলে ফল ধরে না, কুঁড়ি শুকিয়ে যায় ও ঝরে পড়ে। দ্বিতীয় ছত্রাকটির আক্রমনে আক্রান্ত পুষ্প মঞ্জরী হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায় ও কুঁড়ি ঝরে পড়ে।
প্রতিকার -
আক্রান্ত ক্ষেতে ০.১-০.২% ডাইফোলাইট বা ০.২-০.৩% ম্যানকোজেব বা ০.০৪% ফাইটোলান ১০-১৫ দিন অন্তর স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়। মেঘলা আবহাওয়ায় এ রোগ বেশী হয় তাই, ওই আবহাওয়াতে উপরোক্ত ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে অথবা সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য বীজ বোনার ৪৫, ৬০ ও ৭৫ দিন পরে উপরোক্ত ওষুধ স্প্রে করা যেতে পারে।
৫. মৌরি চাষে পাতায় দাগ -
এ রোগ এক জাতীয় ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত গাছের পাতায় বাদামী থেকে কালচে দাগ হয়ে থাকে। একই ধরনের দাগ দেখা যেতে পারে কান্ড, পুষ্পদন্ড ও কচি ফলের গায়েও। আক্রান্ত গাছ চক্চকে দেখা যায়।
প্রতিকার -
আক্রান্ত ক্ষেতে ০.১-০.২% ডাইফোলাইট বা ০.২-০.৩% ম্যানকোজেব বা ০.০৪% ফাইটোলান ১০-১৫ দিন পর স্প্রে করা যেতে পারে। মেঘলা আবহাওয়ায় এ রোগ বেশী ছড়ায় তাই, ওই আবহাওয়াতে উপরোক্ত ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে অথবা সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য বীজ বোনার ৪৫, ৬০ ও ৭৫ দিন পরে উপরোক্ত ওষুধ স্প্রে করা যেতে পারে।
মৌরি চাষে ফসল সংগ্রহ:
মৌরি গাছের ফল ৭-৮ মাসে তোলার উপযোগী হয়ে যায়। ফল হলুদাভ বর্ণ ধারণ করলেই গাছ কেটে খামারে তুলে আনা ভালো। মাঠেই পুরোপুরি পেকে গেলে ফল ঝরে নষ্ট হবে ও বীজের গুনমান খারাপ হতে পারে। মৌরির সব পুষ্পছত্র একমাসে পাকে না। তাই, ১০-১৫ দিন অন্তর ৪-৫ বার পেকে যাওয়া ফল তুলে নিতে পারলে ফলন বেশী হবে ও ফসলের গুনমান ভাল থাকবে।
আরও পড়ুন - গোলাপ চাষে এই মাসে কৃষকদের বিশেষ কী কী যত্ন নিতে হবে