আগেকার দিনে মানুষের স্থানাভাব ছিল না বললেই চলে, বিরাট বিরাট বাগানের চল, বাবুয়ানা দেখানোর বাগানবাড়িও আকছার দেখা মিলতো। জনবসতি বেড়ে ওঠায় উন্মুক্ত জায়গা ক্রমশ কমে আসছে, সবুজের বুক চিরে কংক্রিটের দাপাদাপি। এর মাঝেও সাধ্যের মধ্যে সাধপূরণ করতে কে না চায়, তাই আর বাগানবাড়িতে নয়, কয়েকশো স্কোয়্যার ফুটের ছোট ফ্ল্যাট বা বাড়ির অন্দর সেজে উঠছে বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, কমলালেবু এই সব মহীরুহে।
সবুজের বুক চিরে কংক্রিট যেমন মাথা তুলেছে, সেই কংক্রিটের ক্রোড়েই আবার সবুজ ও আভিজাত্যের ছোঁয়ায় বেড়ে উঠছে তপোবন। নেমে আসুক বটের ঝুড়ি, ফলভারে নুয়ে পড়ুক কমলালেবুর গাছ, লালে লাল হয়ে প্রভাতের নবারুণের মত ভরে উঠুক কৃষ্ণচূড়া। এও কি সম্ভব! শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও হ্যাঁ, এগুলোও সম্ভব, বনসাই পদ্ধতিতে করা গাছের মাধ্যমে এই অসম্ভবও সম্ভবপর।
বনসাই-এর জন্য আদর্শ চারা (Ideal seedlings for bonsai) -
কলম থেকে তৈরি চারা বনসাই-এর জন্য আদর্শ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এক্ষেত্রে টব ও মাটি। এর জন্য প্রয়োজন ছোট, চওড়া, কম গভীর, বৃত্তাকার, আয়তাকার, বর্গাকার কিংবা ত্রিভুজাকার টব। মাটি বা সেরামিকের টব দেখতে সুন্দর হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়, কারণ বনসাই-এর প্রধান উদ্দেশ্যই তাকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা। প্লাস্টিকের টব ব্যবহার না করা উচিৎ।
আদর্শ মাটি (Soil preparation) -
বনসাই-এর জন্য মাটি পলি বা দোআঁশ হওয়া উচিত, মাটিতে জৈব সার মিশিয়ে দেওয়া দরকার। জৈব সারের মধ্যে সমপরিমাণ ইটগুঁড়ো, হাড়গুঁড়ো, কাঠের ছাই, খড়িমাটি মিশিয়ে সার তৈরি করা হয়। অনেকক্ষেত্রে রাসায়নিক সারও ব্যবহার করা হয়, কিন্তু বনসাইয়ের দীর্ঘ জীবনের জন্যে তা ভালো নয়। মাটি ও সারের অনুপাতে সারের পরিমাণ বেশি হওয়া উচিত। মাটি তৈরী হয়ে গেলে টবের ছিদ্রতে এক টুকরো তারের জালি রেখে তার উপরে কাঁকর বিছিয়ে তার পরে মাটি ও সারের মিশ্রণটি দিয়ে দিতে হবে।
পরিচর্যা (Crop care) -
চারাগাছ যখন বাড়ন্ত, ঠিক তখনই শিকড়, মুলকান্ড ও শাখার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তবে তার মানে অবশ্যই তা নষ্ট করা নয়। বনসাই-এর গাছ বেঁটে ও ঝোপের মতো ঝাঁকড়া হওয়া উচিত। তার জন্য বাড়ন্ত গাছের কুঁড়ি বা পাতার মুকুল ভেঙে দিতে হবে। বেশি ছোট করতে চাইলে নিয়মিতভাবে পাতা ও কাণ্ড ছাঁটতে হবে। বাড়ন্ত ডগা কেটে ফেললে গাছের শাখার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে গাছ ঘন হয়। কৃত্রিম উপায়ে তামার তার বেঁধে বনসাই গাছের শাখাকে সুন্দর, সুঠাম ভঙ্গিমায় সহজেই আনা যায়।
আরও পড়ুন - বনসাই -এর শখ রয়েছে? কীভাবে বনসাই করবেন? জানুন বনসাই ফার্মিং সম্পর্কে বিস্তারিত
জল প্রদান –
মাটি শুকনো হলে তবেই জল প্রয়োগ করতে হবে, বিকালের দিকে জল দিলে ভালো। টবে যাতে জল না জমে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। দক্ষিণের জানালা বনসাইয়ের পক্ষে আদর্শ।
বনসাই করতে কিছু জিনিস আবশ্যিকভাবে মাথায় রাখতে হবে-
১) বনসাই অতিরিক্ত জল ও রোদ-কোনোটাই সহ্য করতে পারে না।
২) বনসাই-কে ধুলো-ময়লামুক্ত রাখতে জল দিয়ে পাতা ও ডাল মুছে দেওয়া উচিত।
৩) পাত্রের মাটিতে পোকামাকড় বা ছত্রাকের প্রাদুর্ভাব হলে সঠিক মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করা উচিত।
৪) আলো-বাতাস চলাচল করা স্থান, কিন্তু লোকজনের যাতায়াত কম, এমন জায়গা বেছে নিতে হবে।
৫) আকৃতি ঠিক রাখতে নির্ধারিত ডালপালা বাদে ছাঁটাই করুন।
৬) পরিচর্যার জন্য সময়ের অভাব থাকলে সঠিক মাত্রায় তরল সার প্রয়োগ করতে হবে।
৭) প্রতি এক বছর অন্তর টবের মাটি পরিবর্তন করতে হবে।
৮) ছাঁটাই ইত্যাদি অন্যান্য কাজে বনসাই পরিচর্যার জন্য নির্ধারিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা উচিত।
বনসাই করলেই শুধু হবে না, ধৈর্য ধরে নিয়মিত তার যত্নআত্তিও করতে হবে। ঘরের অন্দরসজ্জায় সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা আনতে, চার দেওয়ালের বদ্ধ ঘরে মুক্তির আনন্দ খুঁজে নিতে, ক্ষুদ্রের মধ্যে বিরাটের আভাস এই বনসাই-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন - জেনে নিন চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম
Share your comments