পাট ভারতের এক প্রাকৃতিক তন্তু ফসল। প্রধানত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করেন। ঘরোয়া প্রয়োজন মেটানো ব্যতীত কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য পাট চাষ হয় – তাই পাট অর্থকরী ফসল।
পশ্চিমবঙ্গে হুগলী, নদীয়া, হাওড়া, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, সহ উত্তরের মালদা, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে পাট চাষ হয়। মে-জুন-জুলাই মাসে পাট পচানো গন্ধ পাট চাষের জানান দেয়। আজও ভারতের অধিকাংশ চাষী গতানুগতিক পদ্ধতিতেই পাট চাষ করেন। আর তাই জাতীয় স্তরে এর উৎপাদনশীলতা বিঘা প্রতি মাত্র ৩-৩.৫ ক্যুইন্টাল (৮-১০ মণ)। পাট চাষের বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে আজ বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
মৃত্তিকা – বেলে দো-আঁশ, পলি দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে পাট ভালো হয়। মাটির পি.এইচ ৫.৫-৭.৫ আদর্শ। সাধারণত উঁচু ও মাঝারি জমিতে মিঠা পাট ও সব জমিতে তিতা পাট চাষ করা যায়। বীজ বোনার ৬০ দিন পর তিতা পাট দাঁড়ানো জল সহ্য করতে পারে, কিন্তু মিঠা পাট কোনভাবেই জল সহ্য করতে পারে না।
অনুকূল আবহাওয়া -
প্রাথমিকভাবে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া দরকার। পাটের বৃদ্ধির জন্য ২৪-৩৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা এবং ৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা উপযুক্ত। আরেকটি দিক হল পাটের ভালো বৃদ্ধির জন্য সমবন্টিত ১৫০০-২০০০ মি.মি. বৃষ্টি প্রয়োজন, যার মধ্যে ২৫০ মি.মি. ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত দরকার, যখন পাট বোনা হয়।
জমি তৈরী – মাটি খুব ভালো করে চাষ দিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে কারণ, পাটের বীজ খুব ছোট। জমিকে ৫-৬ বার লাঙল অথবা ২-৩ বার ট্রাক্টর (হ্যারো) দিয়ে চাষ করা দরকার। মনে রাখতে হবে, ভালোভাবে চারা বেরনোর জন্য জমি সমান করা অবশ্যই দরকার।
উন্নত জাত – ভাল ফলনের জন্য ভালো জাত আর ভালো বীজ সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মিঠা বা তিতা পাটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – নবীন (জেআরও ৫২৪) বিঘা প্রতি যার গড় ফলন ৪-৪.৫ ক্যুইন্টাল, চৈতালী (জেআরও ৮৭৮) ফলন ৩.৫-৪ ক্যুইন্টাল, বাসুদেব (জেআরও ৭৮৩৫) ফলন ৪-৪.৫ ক্যুইন্টাল, বৈশাখী (জেআরও ৬৩২) ফলন ৩.৫-৪ ক্যুইন্টাল। আর তিতা পাট বা সাদা পাটের মধ্যে সোনালী (জেআরসি ৩২১), সবুজ সোনা (জেআরসি ২১২) ও শ্যামলী (যেআরসি ৭৪৪৭) বিঘা প্রতি যাদের গড় ফলন – ৩.৫-৪ ক্যুইন্টাল। ইদানীং সময়কালে ব্যারাকপুর পাট গবেষণা কেন্দ্র থেকে উদ্ভূত কিছু নতুন মিঠা পাটের জাত – সুরেন (জেআরও ২০৪), ইরা (জেবিও ২০০৩ এ), সৌরভ (ইঘ ৫৮), যাদের গড় ফলন বিঘা প্রতি ৪.৬-৫.৩ ক্যুইন্টাল। হুগলী জেলায় কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত গবেষণায় দেখ গেছে কৃষকদের জমিতে নবীনের পরিবর্তে সুরেন জাতটি বেশ উল্লেখযোগ্য সাড়া ফেলেছে।
বীজ শোধন ও বীজ বপন – বীজবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বীজ শোধন একান্ত আবশ্যক। প্রতি কেজি বীজের জন্য কার্বেন্ডাজিম ২ গ্রাম অথবা ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ৫ গ্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে। বীজ বোনা সাধারণভাবে স্থান অনুযায়ী, মাটির আর্দ্রতা, কালবৈশাখী ঝড়, বৃষ্টি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। সাধারণত চৈত্র (মার্চ মাসের মাঝামাঝি), থেকে বৈশাখ (এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি) পাট বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। ছিটিয়ে বীজ বোনার চেয়ে সারিতে বীজ বুনলে যেমন বীজ কম লাগে, তেমনি নিড়ানি বা অন্তর্বর্তী কাজের খরচও অনেক কম হয়। মিঠা পাট ছিটিয়ে বুনলে বিঘা প্রতি ১ কেজি আর সারিতে বুনলে ৮৫০ গ্রাম বীজ লাগে। ছিটিয়ে বীজ বোনার চেয়ে সারিতে বুনলে ফলনও অপেক্ষাকৃত বেশী পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে, এক সারি থেকে অপর সারির দূরত্ব মিঠা পাটের জন্য ২০ সেমি. : ৫-৭ সেমি. আর তিতা পাটের জন্য ২৫ সেমি. : ৫-৭ সেমি.। সর্বস্তরে প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কৃষকদের সারিতে পাট বোনার বিষয়ে তেমনভাবে আগ্রহী করা যায় নি, যদিও ইদানীং সাড়া মিলছে কিছু প্রগতিশীল কৃষকের বিজ্ঞানসম্মত চাষে উদ্যোগী হওয়ায়।
সার প্রয়োগ – মাটি পরিক্ষা করে সার প্রয়োগ করা ভাল। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য যে জমি তৈরীর সময় বিঘা প্রতি ৮-১০ ক্যুইন্টাল জৈব সার এবং ১ কেজি করে অ্যাজোটোব্যাক্টর ও পিএসবি প্রয়োগ করা দরকার জমির সার্বিক উন্নতির জন্য।
তিতা পাটের ক্ষেত্রে কম উর্বর জমিতে নাঃফঃপঃ – ৬০:৩০:৩০ হেক্টরে (বিঘা প্রতি ৮:৪:৪ কেজি), মাঝারি উর্বর জমিতে যথাক্রমে ৫০:২৫:২৫ হেক্টরে (বিঘা প্রতি ২.৬:১.৩:১.৩ কেজি) আর উর্বর জমিতে নাঃফঃপঃ – ৪০:২০:২০ হেক্টরে (বিঘা প্রতি ২.৬:১.৩:১.৩ কেজি)। তাই মাঝারি ক্ষমতাসম্পন্ন জমিতে তিতা পাটের জন্য ইউরিয়া ১৮ কেজি, এসএসপি ২০ কেজি এবং এমওপি ৫.৫ কেজি প্রয়োজন।
মিঠা পাটের ক্ষেত্রে কম উর্বর জমিতে নাঃফঃপঃ – ৫০:২৫:২৫ হেক্টরে (বিঘা প্রতি ৬.৬:৩.৩:৩.৩ কেজি), মাঝারি উর্বর জমিতে যথাক্রমে নাঃফঃপঃ – ৪০:২০:২০ হেক্টরে (বিঘা প্রতি ২.৬:১.৩:১.৩ কেজি) ও উর্বর জমিতে নাঃফঃপঃ – ৩০:২০:৩০ হেক্টরে (বিঘা প্রতি ৪:১.৩:৪ কেজি)। সহজ হিসাব করলে মিঠা পাটের ক্ষেত্রে মাঝারি জমির জন্য ইউরিয়া ৬ কেজি, এসএসপি ৮ কেজি এবং এমওপি ২ কেজি।
মূল সার হিসাবে ইউরিয়া সার না প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ ফসফেট ও অর্ধেক পটাশ সার এবং চাপান হিসাবে মোট নাইট্রোজেন সারের অর্ধেক এবং বাকি পটাশ সার ২ ভাগে বীজ বোনার ১৫ দিন ও ৩৫-৪০ দিন পর দিতে হবে। চাপান সার দেওয়ার আগে জমি পাতলা ও আগাছামুক্ত করে নিতে হবে। অনেক সময় শেষ চাপান সার মাটিতে প্রয়োগ না করে পাতায় স্প্রে করলেও ভালো ফল পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ইউরিয়ার ২ % জলীয় দ্রবণ (২০ গ্রাম প্রতি লিটার জলে অর্থাৎ ব্যারেলে ৩০০ গ্রাম) ৩৫ বা ৫০ দিনের মাথায় পাতার নীচে স্প্রে করা যায়। বিঘা প্রতি ১০০ লিটার দ্রবণ দরকার। স্প্রে করার সময় ইউরিয়ার জলীয় দ্রবণের সাথে চাইলে রোগ বা পোকা নিয়ন্ত্রণ করার ঔষধ মেশানো যাবে। পাটের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার জলে ১ গ্রাম অক্টাবোরেট গুলে চারার ৩ ও ৬ সপ্তাহ বয়সে বিঘা প্রতি যথাক্রমে ৩০ ও ১০০ লিটার জল স্প্রে করা হয়। এছাড়াও ঘাটতি যুক্ত জমিতে ৩-৪ বছরে একবার বিঘা প্রতি ১.৫ কেজি বোরাক্স জমি তৈরীর সময় দিতে হবে।
অন্তর্বর্তী পরিচর্যা - বীজ বোনার ১৫-২০ দিন পর অর্থাৎ চারার বয়স ৭-১০ সেমি. হলে প্রথম বার এবং ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বার অর্থাৎ চারার বয়স ২০-২২ সেমি. হলে নিড়ান দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ছিটিয়ে বোনা পাটে ১০ সেমি. অন্তর ও সারিতে বোনা পাটে ৫-৭ সেমি. অন্তর চারা তুলে পাতলা করতে হবে। প্রতি বর্গ মিটারে ৫০-৬০ টি সুস্থ সবল চারা রেখে বাকি তুলে ফেলতে হবে। ভালো ফলনের জন্য এটা ভীষণ কার্যকরী।
পাটের আগাছা নিয়ন্ত্রণ – সব ফসলের মতই আগাছা পাট চাষেও এক গভীর সমস্যা, যা সময় মতো নিয়ন্ত্রণ না করলে ফলনে বেশ প্রভাব পরে। তাই নিম্নে উল্লিখিত বিষয়গুলিতে বিশেষ নজর দিতে হবে। যেমন –
ক) আগাছামুক্ত বীজ ও জৈব সার।
খ) রাসায়নিক সার অযথা না ছড়িয়ে যতটা সম্ভব গাছের কাছে ব্যবহার করতে হবে।
গ) বোনার ১৫ এবং ৩০ দিনের মাথায় নিড়ান ২ বার ব্যবহার করতে হবে (সম্ভব হলে)।
ঘ) খড়, কচি পার্থেনিয়াম ইত্যাদির আচ্ছাদন ব্যবহার করতে হবে।
ঙ) সময়মতো সঠিক পরিমাণে আগাছা নাশকের ব্যবহার। সেক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে বিঘা প্রতি ৪ ব্যারেল জল বা ৬০ লি. জলে আগাছানাশক ঔষধ ভালো করে মিশিয়ে ভেজা আর্দ্র জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আগাছানাশক, যা পাটে ব্যবহার করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। যেমন – ক্যুইজালোফপ-পি-ইথাইল (তরগাসুপার, অ্যাসুওর) বিঘা প্রতি ১৩৫ মিলি. বীজ বোনার ২০-২৫ দিন পর, ফ্লুয়াজিফপ-পি-বিউটাইল (ফুসিলেড, সুপার্ট, পিউজিলেট সুপার) বিঘা প্রতি ৩০০ মিলি. বীজ বোনার ১৫-১৮ দিন পর, প্রোপাক্যুইজাফপ (সোসাইটি, অ্যাজিল) ১০০ মিলি. ১ বিঘার জন্য বীজ বোনার ২১-২৫ দিন পর অথবা ফেনোক্সাপ্রপ-প্রি-ইথাইল (হুইপসুপার) বীজ বোনার ২৫-৩০ দিন পর বিঘা প্রতি ৪০ গ্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে। একদম শুরুর দিকে আগাছা বেড়নো আটকাতে গেলে পেন্ডিমিথালইন (স্টম্প, পেন্ডিগান ইত্যাদি) বিঘা প্রতি ৩০০ মিলি. অথবা ট্রাইফ্লুরালিন (ট্রেফলান, ট্রাইফোগান, ক্লিন) ১২০ মিলি. বোনার ১-২ দিন পর ভেজা মাটিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়াও প্রধানত ঘাস বা চওড়া পাতা মারার জন্য বিউটাক্লোর (ম্যাচিটি, ফিনিশ, তীর) প্রতি লিটার জলে ৩ মিলি. বীজ বোনার ২ দিন আগে এবং ক্যুইজালোফপ-পি-ইথাইল ২-২.৫ মিলি. প্রতি লিটার জলে গুলে ১৫-২০ দিন পর স্প্রে করতে হবে।
রোগ-পোকা (Disease & Pest management) – পাটের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পোকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আংকা ও শুঁয়োপোকা, যার জন্য ক্লোরপাইরিফস ২.৫ মিলি. অথবা কার্বসালফান ২ মিলি. প্রতি লিটার জলে স্প্রে করতে হবে। ঘোড়া পোকার জন্য অ্যাসিফেট ও ফেনভেলারেট ১ মিলি. করে আর ল্যাদা পোকার জন্য নোভালিউরন ১ মিলি. প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া হলুদ মাকড়ের জন্য প্রোপারজাইট (২ মিলি./লি.) ও লাল মাকড়ের জন্য ফেনাজকুইন (২ মিলি./লি.) ব্যবহার করা যেতে পারে। গোড়াপচা আর হুগলী উইল্ট হল পাটের প্রধান রোগ। যে জন্য শুরুতেই বীজ শোধন করতে হবে কার্বেন্ডাজিম (১ গ্রাম/লি.) দিয়ে। পরে কপার অক্সিক্লোরাইড (৪ মিলি./লি.) বা কার্বেন্ডাজিম (১ গ্রাম/লি.) স্প্রে করা দরকার। এছাড়া হুগলী উইল্ট যেহেতু ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও নিমাটোডের সম্মিলিত কারণে হয়, তাই সেইসব জমিতে ১০০ কেজি জৈবসারের সাথে ১ কেজি ট্রাইকোডার্মা ও ১ কেজি সিউডোমোনাস ফ্লরোসেন্স মিশিয়ে এক বিঘা জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও পাটে কালো কালো ক্ষত বা অ্যানথ্রাকনোজ দেখা দিলে গোড়াপচার মতই কার্বেন্ডাজিম (২ গ্রাম/কেজি বীজ) দিয়ে বীজ শোধন করে পরে আবার কার্বেন্ডাজিম (১ গ্রাম/লি.) স্প্রে করতে হবে।
সেচ – পাট চাষ মূলত বৃষ্টি নির্ভর। বৃষ্টির অভাব হলে অবশ্য ২ বার সেচ দিতে হবে। অনেক সময় বৃষ্টি অনিশ্চিত হলে ১ টি সেচ দিয়ে ও সুপারিশ মত সার দিয়ে পাট বুনুন। এতে বিঘা প্রতি ৩.৫-৪ ক্যুইন্টাল ফলন পাওয়া যাবে। খরার ঝুঁকি এড়ানোর জন্য পন্ত মুগ ৫ ই মার্চ ও পাট ২২ শে মার্চ তারিখে ৯:৯ অনুপাতে সারিতে বুনুন। ৯ ফলা কালটিভেটর দিয়ে সারি তৈরী করে বীজ নালাতে বুনুন। তারপর মই ও সেচ দিন।
পাট কাটা ও পচানো – সাধারণভাবে পাট কাটা হয় প্রায় ১১০-১২০ দিন পর। কাটার পর জমিতে ৩-৪ দিন ফেলে রাখলে সব পাতা ঝরে যায়। ধীরে বয়ে যাওয়া পরিষ্কার মিঠা জলে পাটের পচন খুব ভালো হয়। আয়রনযুক্ত বা কাদা জলে পাট পচানো উচিত নয়। পাট গাছ বান্ডিলে বেঁধে ইঁট, পাথর বা কাঠ ইত্যাদির ভার দিয়ে এক হাত জলের তলায় ডুবিয়ে রাখা দরকার। সম্পূর্ণ হলে গাছ বা কাঠি থেকে তন্তু ছাড়িয়ে নিয়ে বাঁশের কাঠামোতে রোদে রেখে শুকানো হয়। শুকনো তন্তু প্রয়োজন মত বান্ডিল বেঁধে বাজারে বিক্রি হয়। সাধারণভাবে পাটের তন্তু একটি পক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ থেকে বার করা হয়। যথাযথ তাপমাত্রায় জলের জীবাণুর সাহায্যে পাটের টিস্যু (কলা) গুলি ক্রমাগত নরম করার পর তন্তুগুলি বের করফে নেওয়া হয়। ভালো পাট বের করার ক্ষেত্রে সময় গুরুত্বপূর্ণ। যদি পাট কম পচানো হয়, তাহলে ছাল ছাড়ানো সহজ হবে না। আর বেশী হলেও খারাপ, সেক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া শুধু গাছের কলা কে ভাঙাবে না, সাথে সাথে তন্তুর উপর আক্রমণ করেও তন্তু কে দুর্বল করে দেবে।
এই পাট পচানো বা প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি দুটি পর্যায়ে ঘটে, ভৌত পর্যায় ও জৈব রসায়ন পর্যায়। ভৌত পর্যায় হল, যখঙ পাট কেটে জলে ভেজানো হয় এবং টিস্যুগুলি জল টেনে নিয়ে জলে দ্রবীভূত উপাদান তৈরী করে। আবার জৈব রাসায়নিক পর্যায়ে যে বস্তুগুলির (বাইকার্বোহাইড্রেটস, নাইট্রোজেনঘটিত যৌগ এবং বিভিন্ন প্রকার লবণ) নিষ্কমণ হয়, তা প্রক্রিয়ারত হলে মাইক্রোবস বা জীবাণুর সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায়। প্রক্রিয়াকরণ সেশ হলে বান্ডিলগুলি জল থেকে বের করে এনে শারীরিক ক্ষমতা বলে একে একে তন্তুগুলি বার করা হয়। এছাড়াও পেটানো, ভাঙা ও ঝাঁকুনি দেওয়া পদ্ধতিতেও তন্তু নিষ্কাশন করা হয়। পাট চাষ ও পরবর্তী পর্যায়ে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে উৎপন্ন তন্তুর গুনগত মান নির্ভর করে যে বিষয়ের উপরে, সেগুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া উচিত, কারণ এর উপরেই পাটের দাম নির্ভর করে। যেমন -
ক) গাছের বয়স – ১১০ দিনের বেশী হলে লিগনিন বেড়ে যায়, ফলে পচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
খ) জলের মান – দূষণমুক্ত অল্প প্রবহমান জল ভালো পাট পচানোর জন্য আদর্শ। এ বিষয়ে বিশেষ অনীহা বা সমস্যা দেখা যায়।
গ) অম্লত্ব/ক্ষারত্ব – জলের পি.এইচ-এর মাত্রা ৬-৮ থাকা বাঞ্ছনীয়।
ঘ) তাপমাত্রা – সর্বাধিক তাপমাত্রা ৩৪-৩৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড, এই তাপমাত্রায় জীবাণুর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ঙ) জলের গভীরতা – জীবাণুর কাজ ১৫ সেমি. গভীরে সর্বাধিক সম্পন্ন হয়। এই গভীরতায় প্রক্রিয়াকরণও ভালো হয় এবং ত্বরান্বিত হয়, ৩৫ সেমি. গভীরতা পর্যন্ত কাজ করে, কিন্তু তার নীচে জীবাণুর কর্মক্ষমতা কমে যায়। তাই পাটের বান্ডিল বেশী গভীরে ডোবানো উচিত নয়।
চ) অন্য গাছের উপস্থিতি – ধইঞ্চা বা সানহেম্প জাতীয় লেগুমিনাস সম্প্রদায়ভুক্ত গাছে নাইট্রোজেন বেশী থাকায় জীবাণুর কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
এছারা খরায় বা পচানোর জন্য জলের অভাব হলে কেন্দ্রীয় পাট ও সহজাত তন্তু গবেষণা সংস্থা, ব্যারাকপুর থেকে উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতিতে কম জলে পাট পচানো যায়। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে আলাদা করে ক্রাইজাফসোনা নামক জীবাণু ব্যবহার করলেও ভালোভাবে পাট পচানো যায়, আবার সময়ও কম লাগে।
পাট চাষে লাভের পরিমাণ বাড়াতে গেলে শুধু উৎপাদন বেশী করলেই হবে না, তাকে ভালোভাবে পচাতে হবে, যাতে পাটের গুনগত মান ভালো থাকে। কোন কোন বিষয়গুলির উপর পাটের উৎকর্ষতা নির্ধারণ করা হয়, অর্থাৎ পাট কতটা ভালো ঠিক করা হয়, সেই বিষয়গুলিও কৃষকবন্ধুদের জানতে হবে। তবেই তো তারা দাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারবেন। টিডি-১ থেকে শুরু করে টিডি-৮ পর্যন্ত মোট ছয়টি গুনের উপর ভিত্তি করে পাটের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়, যার উপর পাটের দাম নির্ভর করে। সেই ছয়টি গুন হল আঁশের শক্তি বা দৃঢ়তা, গোড়ছাল, ত্রুটি বা দোষ, আঁশের রঙ বা বর্ণ, আঁশের সূক্ষ্মতা ও আঁশের ঘনত্ব। এই গুনাগুন সম্পর্কে কৃষকবন্ধুদের ওয়াকিবহাল থাকতে হবে, তবেই পাট বিক্রির সময় উপযুক্ত দাম নির্ধারণে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
প্রবন্ধ লেখক – ড. কিরনময় বাড়ৈ (বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী ও প্রধান, হাওড়া কেভিকে)
Share your comments