ভারতীয় চা শিল্পের কাছে ২০১৭ সালটি অত্যন্ত কঠিন বছর, কেননা এই সময়ে প্রত্যাশিত লাভ পাওয়া যায়নি। ক্রমাগত দামের হেরফের ও কম প্রাপ্তি সমস্ত চা কোম্পানির বৃদ্ধিকে সর্বস্তরে আঘাত এনেছে, যদিও চায়ের উৎপাদন কম হয়নি। যেখানে উত্তর ভারতের ১০-১৫ শতাংশ কোয়ালিটি (গুনগত) চা সামান্য হলেও কিছুটা ভালো দাম পেয়েছে, সেক্ষেত্রে অন্যান্য চা ২০১৬ থেকে লাভের মুখ দেখেনি। গড়ে উত্তরভারতের চা-এর মূল্যের হ্রাস পেয়েছে প্রতি কেজিতে ১ টাকা এবং দক্ষিণ ভারতের চা-এর মূল্যের অবনয়ন হয়েছে প্রতি কেজিতে ৬ টাকা ৫০ পয়সা। সারা ভারতে চায়ের গড় মূল্য প্রতি কেজিতে ১৩২.৮০ টাকা যা কিনা ২০১৩ র মূল্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যাই হোক, গত চার বছরে দাম বেড়েছে অনেকটা। যে কোন চা-শিল্পকে যদি অস্তিত্ব বজায় রাখতে হয়, উন্নতি ঘটাতে হয় এবং সেবা/পরিষেবা মূলক কর্মসূচীকে সার্থক করতে হয়, তবে বাণিজ্যিক ভাবে আর্থিক লাভে লাভান্বিত হওয়া জরুরি।
১৯১৭ সালে যত সময় এগিয়েছে ততই ভারতীয় কৃষিকে অস্বাভাবিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কোন একটি মাসে হয়তো রেকর্ড উৎপাদন হল, পরের মাসেই উৎপাদনের পরিমাণ হঠাৎ কমে গেল। উত্তরভারতে শস্যের কম ফলনের জন্য খারাপ আবহাওয়া, কম সেচের সুযোগ, বেশি দাম ইত্যাদিকে দায়ী করা হচ্ছে। যাই হোক, দক্ষিণ ভারতে ২০১৬ সালে যে খারাপ পরিস্থিতি ছিল, পরে তা অনেকটাই শুধরে গেছে।
বিশ্বের ক্ষেত্রে কেনিয়া সহ অন্যান্য আফ্রিকান দেশ ও বাংলাদেশ ২০১৭ সালে শস্যেতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। সমস্ত চা উৎপাদনকারী দেশকে যদি একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়, তবে ক্ষতির পরিমান ২৫ মিলিয়ন কেজি। যেটুকু উদবৃত্ত আছে তাও ২০১৮-র শুরুতেই কমে যাবে বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, ইত্যাদির ২০১৭ তে অর্থকরী লাভ ভালই হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ এখন প্রতি মৌসুমেই চাষ হবে সবজির ! বিজ্ঞানীদের তৈরি এই নতুন প্রযুক্তিতে সুফল পাবেন কৃষকরা
আসামে ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন(ITA)-র সদস্যভুক্ত যে সমস্ত এস্টেট অধিক পরিমান অর্থডক্স চা তৈরী করেছে, তারা রপ্তানীর সুযোগ বেশী পেয়েছে। সুতরাং ২০১৭ সালে তাদের রপ্তানিও বেড়েছে। অর্থোডক্স চা-এর বিক্রি একনাগাড়ে বিশেষ করে বছরের শেষভাগে খুব ভালমত বেড়েছে যার ফলে ২০১৬ থেকে আর্থিক লাভ বেশী মিলেছে। CTC-চা এর থেকে অর্থোডক্স চায়ে খরচ অধিক বেড়ে যাওয়ায় এবং রপ্তানী বাজারে অনিশ্চয়তা থাকায়, উৎপাদনকারীরা সাধারণত বেশী অর্থোডক্স চা উৎপাদন করতে ইতস্তত হচ্ছে। ITA এর জন্য টি বোর্ডকে অনুরোধ করেছে যাতে তারা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়, এবং অর্থোডক্স উৎপাদনকারীদের সাহায্য করে।
এ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ক্ষুদ্র চা চাষিদের (STG) উপস্থিতি (উন্মেষ) যারা বহু চা কোম্পানি (leaf factory) কিনেছে। সারা ভারতের উৎপাদনের ১০% শেয়ার থেকে তা এখন ৪৬% শেয়ারে পৌঁছেছে। ভালো গুণমাণের উৎপাদন পেতে অর্গানাইজড (গোছানো) সেক্টর রিপ্লান্টেশন ও রেজুভেনেশনের মাধ্যমে পুরানো গাছগুলির উন্নতি আনার চেষ্টা করেছে। এই ক্ষুদ্র উৎপাদন গোষ্টী (STG) নতুন গাছের (bush) সাহায্যে আরও উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়াস নিয়েছে। এই বিষয়টি স্থানীয় মানুষদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে। কিন্তু মুশকিল হল, এতেও প্রতিবছর বাজারে চা উদবৃত্ত থাকছে, এর ফলে ভারতে নিয়মিত ব্যাবহার ও রপ্তানীর ক্ষেত্রে হতাশা এসেছে।
FSSAI – ভারতে খাদ্য গুণমাণের নিয়ন্ত্রন সংস্থা- প্রতিনিয়ত চা-এর গুনমান যাচাই করছে। বহু আলোচনা এবং অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর FSSAI অবশেষে চায়ে লৌহকনা (Iron Fillings) সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রতি কেজিতে ২৫০ মিলিগ্রাম পরিমাণ নির্দিষ্ট করলো। এটা খুবই আকর্ষণীয় পদক্ষেপ।
আরও পড়ুনঃ আমের ভালো ফলনের জন্য কৃষকদের এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে
ট্রপিকাল অঞ্চলে উপস্থিতি থাকার জন্য চা-বাগিচা গুলিতে পোকামাকড়ের ভয়ংকর উপদ্রব হয়। কখনও কখনও পোকামাকড়ের আক্রমণ এত বেশী হয় যে বাগানের পর বাগানে এর জন্য মারাত্মক ক্ষতি হয়। তখন এই কঠিন অবস্থা থেকে বাঁচতে চা – চাষিরা রাসায়নিক কীটনাশক পদার্থ ও রোগ নিয়ন্ত্রক ওষুধ প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। টি বোর্ড সম্প্রতি Plant Protetion Code বানিয়েছে যাতে নির্দিষ্ট করা হয়েছে কোন কোন রাসায়নিক কীটনাশক পদার্থ চা বাগিচায় ব্যাবহৃত হবে। এর সাথে সাথে FSSAI কিছু রাসায়নিক পদার্থের নাম ও তার সাথে ঐ পদার্থের MRL(Maximum Residue Limit, সবচেয়ে বেশী অবশেষ সীমা) নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
এই MRL এর বাইরে চা ইন্ডাস্ট্রি অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করতে পারবেনা। বাস্তবে দেখা গিয়েছে যে MRL পরিমাণ সনাক্ত করা যায় যা হওয়া উচিত নয়। যখন CODEX, EU-র মতো আন্তর্জাতিক মাণক FSSAI-র বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট MRL ( সর্বোচ্চ অবশেষ পরিমাণ) থেকেও বাড়ানো, তখন FSSAI-র করা MRL পরিমাণের কড়াকড়িতে ভারতীয় চা রপ্তানীকারকেরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই যেটা সবচেয়ে জরুরী, তা হ'ল সমস্ত মাণকগুলির মধ্যে এক সঙ্গতি (harmonization) গড়ে তোলা। সুখের কথা FSSAI, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে। চা গবেষণা কেন্দ্র গুলিকে বলা হয়েছে, যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষালব্ধ ফলাফল যেন FSSAI কে জানিয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় এবং এই বিষয় কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ করে চায়ের চাষেও প্রযোজ্য। কখনও আবার বৃষ্টি নেই। একারণে চা চাষ ভীষণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। শস্যের ক্ষতি সামলাতে, সেচের ব্যবস্থা করতে, রোগ পোকা নিয়ন্ত্রন করতে প্রচুর খরচা বেড়ে যাচ্ছে। ক্ষরা ও রোগ পোকাকে প্রতিরোধ করতে চা বাগিচাগুলিতে সেচ ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। চা –শিল্পের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রকের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে তারা যেন প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিচাই যোজনা (PMKSY) কিংবা প্রধানমন্ত্রী ফসলবীমা যোজনা (PMFBY)-র অনুমতি ক্রপ সেচ এবং ক্রপ ইনস্যুরেন্সের সুবিধা চা শিল্পতেও পাবার জন্য উদ্যোগ নেয়।
প্রকৃতিতে চা চক্রের মত; বছরের পর বছর চা চাষ হয়ে চলেছে। কিছু কিছু খারাপ কারণ চায়ের অর্থকরী লাভের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থের লাভ যাতে বাড়ানো যায়, তার জন্য চায়ের সাথে কোন কোন সাথী ফসলের চাষ করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে।
জনসংখ্যা বাড়ার জন্য ঘরোয়া চায়ের ব্যবহার বার্ষিক ২.৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু এতে per capita consumption কিন্তু বাড়েনি। ভারতে per capita consumption ৭৫০ গ্রামের নীচে, কিন্তু বহু দেশে per capita consumption ১ কিলোর বেশী। ভারতের শক্তি লুকিয়ে আছে নতুন পাতার মত ধীরে ধীরে গঠিত হওয়া ঘরোয়া বাজারের সমৃদ্ধিতে, যার জন্য বিদেশের অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশ ভারতের মত দেশে বাণিজ্যের সুযোগ নিতে প্রস্তুত। ভারতের উচিত নিজস্ব বাজারের দিকে নজর দেওয়া এবং চা এর বিস্তৃত প্রাচুর্যকে ঐ বাজারে ছড়িয়ে ফেলা। দেশের ১৭-২৪ বছরের যুবক/ যুবতীদের অর্ধেকেরও বেশী (২৫০ মিলিয়ন) দিনে ১ বারেরও কম চা পান করে থাকে। যেহেতু ভারত ক্রমাগত যুবা ( ছেলে ও মেয়ে ) বয়সকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তাই সময় এসেছে চা এর ব্যবহারকে আরও কিভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা। জীবনকে সুস্থ ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে চা-এর যে ভূমিকা আছে, তাকে আরও ভালো করে প্রচার করা।
গত চার বছরে মাথা পিছু ব্যবহার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন (ITA) চা এর ব্যবহার সম্প্রচারের জন্য পথ পরিক্রমার মাধ্যমে (Road Show) এক নতুন উদ্যোগ নিয়েছে যা খুবই প্রশংসনীয়। এই পরিক্রমাগুলির নাম ছিল B2B, B2C এবং B2Y। যুবশক্তিকে মাথায় রেখে ( যা কিনা ভারতের জনসংখ্যার সর্বাধিক অংশ)২০১৫ সাল থেকে ITA র উদ্যোগে “Tea Carnival: B2Y – চায়ে হো যায়ে” সর্বজনের প্রশংসা পেয়েছে। ভারতীয় চা শিল্পের অনেক সমস্যা মিটে যায় যদি মাথা পিছু ব্যবহারে গতি আনা যায়, যেমন, “দিনে আরও এককাপ চা”। যাইহোক, নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ITAএর উদ্যোগ বেশ খানিকটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ভারত সরকার ও টি-বোর্ডকে এই অবস্থায় ITA কে সাহায্য করা দরকার।
ভারতীয় টাকার বৃদ্ধি (appreciation) চা রপ্তানিকারকদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া প্রভৃতি দেশ তাদের মুদ্রার মূল্য বাড়িয়েছে, তখন মাত্র গত দুবছরে ভারতীয় মুদ্রার বৃদ্ধি দেশের পক্ষে সুখকর সংবাদ হলেও, রপ্তানির জন্য আয় কিছু কমে গিয়েছে। গত জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর, ২০১৭ ভারতীয় রপ্তানি হয়েছে ২৩৫ মিলিয়ন কেজি, যা কিনা ২০১৬-র রপ্তানি থেকে ১৮ মিলিয়ন কেজি বেশী। গত ৩৫ বছরে সর্বোচ্চ রপ্তানি হল এই ২০১৭ সালেই। এই গতিকে ধরে রাখতে বাইরের দেশের সাথে আরও সুযোগ তৈরি করা জরুরি। এই অনুষঙ্গে ২০১৭ সালে চিলিতে বাণিজ্য প্রতিনিধি পাঠানো এক সার্থক পদক্ষেপ।
আমেরিকা,রাশিয়া ও ইরানে ভারতীয় চা খুবই জনপ্রিয় এবং ওখানে রপ্তানিও খুব দ্রুত বাড়ছে। এই অগ্রগতিকে আরও আগে বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সমন্বয় দরকার যাতে থাকবে সম্প্রসারণ কর্মসূচী, ভাবনা-চিন্তা বিনিময় ও প্রতিনিধি পাঠানো। এই অনুষঙ্গে, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি পাঠানো কয়েকটি দেশে খুবই জরুরি। যেমন- রাশিয়া, ইরান, ইজিপ্ট, কাজাখাস্তান, আমেরিকা, চীন, বাংলাদেশ যেখানে ভারতীয় চা-এর খুব কদর হয়। টি বোর্ড এবং আই টি এ যৌথ ভাবে একটি স্ট্রাটেজী পেপার বানিয়েছিলো সেখানে রপ্তানির টার্গেট রাখা হয়েছিলো ২৫০-২৭০ মিলিয়ন কেজি এবং পরবর্তী সময়ের জন্য ৩০০ মিলিয়ন কেজি। ঐ স্ট্রাটেজী পেপারে যা পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে মান্যতা দেওয়া উচিত।
২০১৮ সালে চা এর উৎপাদন ও রপ্তানি মনে হয় ভালোই হবে। ২০১৭ সালে চা বাগানগুলিতে দীর্ঘদিনের ধর্মঘট থাকায় চা শিল্পে তার বাজে প্রভাব পড়ে। সুখের কথা, আবার চা বাগানগুলিতে কাজ শুরু হয়েছে। মনে হয় দার্জিলিং চা এর উৎপাদন ও রপ্তানি আরও বাড়বে। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা খুবই দরকার। ঘরোয়া চাহিদা ও রপ্তানির পরিমান বাড়ানোর দিকে আরও নজর দিতে হবে। এই দুটি ক্ষেত্রেই টি বোর্ড ও কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের সহায়তা কাম্য।
- সুজিত পাত্র (সচিব, ইন্ডিয়ান টী অ্যাসোসিয়েশন)
Share your comments