
আজকাল কৃষকদের কৃষিক্ষেত্রে আয় বাড়ানোর জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন ধরণের যোজনা আরোপ করার পরিকল্পনা করে চলেছে। শুধু তাই নয়, পাঁচ বছরে একবার দেখা পাওয়া যায় যে সমস্ত রাষ্ট্র নেতাদের, তাঁরাও নাকি কৃষকদের প্রাপ্তি নিয়ে কথা বলছেন, আর এর প্রধান কারণ অবশ্যই ২০১৯ সালের সাধারণ লোকসভা নির্বাচন। এখন ছোট বড় সকল রাজনৈতিক দলেরই মনে হচ্ছে তাঁদের ঘুড়ি না সুতো ছিঁড়ে ভোকাট্টা হয়ে যায়। আর এই কারণেই কৃষক, যুব শিক্ষা, ভুখা ও বেকার সমস্যা নিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক রাজনৈতিক তরজা চলছে, তা সে মৌখিক ভাবেই হোক বা সামাজিক মাধ্যমেই হোক।
সরকার প্রতি নির্বাচনের আগেই কৃষকদের জন্য কোনো না কোনো যোজনার ঘোষণা করে থাকে, কিন্তু তাতে কৃষকদের কোনো উপকারই হয় না। সরকার তাঁর যোজনার কথা শুনিয়েই চুপ করে থাকছে, তাকে এই পৃথিবীতে কবে থেকে চালু করা হবে সেই ব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদাসীন, কারণ প্রকল্পের পরিচালনার ব্যাপারে সরকারি তরফের থেকে কোনো প্রচেষ্টাই করা হয় না। সরকারি যোজনার থেকে লাভ তো মধ্যস্বত্বভোগীদের মধ্যেই বাঁটোয়ারা হয়ে যায়, সেই টাকা কৃষকদের কাছে আসার আগেই কর্পূরের মতো উবে যায়, অবশ্য এর কিছুটা ভাগ আবার সাগরের ঢেউয়ের মতো ফেরত এসে যায় সরকারি খাজানায়।
কৃষক তখনি তাঁর উৎপাদন থেকে লাভ পাবে যখন তাঁর উৎপাদন ব্যয় অনেক কম হবে, ও তারা তাদের ফসলের জন্য ভালো দাম পাবে। আসলে কৃষক একটি মরশুমে তাঁর ফসল উৎপাদন করতে যা খরচ করে তাঁর থেকে মরশুমের শেষে তিনি যা দাম পান তা প্রায় পাতে কিছু না পরার মতই অবস্থা। আর এখন সারা দেশে কৃষকদের যা হাল, তাতে চাষের খরচ সামলানো তো দূরের কথা নিজের ঘরের খরচাও উঠছে না। ক্ষেতকার্যের পারিশ্রমিক যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে কৃষক না চাইলেও তাকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এত কিছু করার পরেও যদি কৃষক তাঁর ফসলের ভালো দাম পেল তো ঠিক আছে, আর যদি ফসলের উৎপাদন কম হল তো সেই কৃষকের সমস্যার কোনো অন্ত থাকে না।
এখন আমি এই সমগ্র ঘটনাটি আপনাদের একটি গাণিতিক উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করছি। একটি ১০ বিঘাতে উৎপাদিত সয়াবিন চাষ থেকে একজন কৃষক ঠিক কতখানি আয় ও ব্যয়ের হিসাব পায় তা সামান্য গণিত শাস্ত্র দিয়ে বুঝিয়ে দিই, আসুন দেখে নেওয়া যাক কৃষক তাঁর জীবনের চারমাস ব্যয় করে ঠিক কত টাকা লাভ করেঃ
কাজ |
খরচ (টাকা) |
সময় এবং মজুরি |
|
২ বার ফসল বোনাই |
৪,৮০০ |
৮ ঘণ্টা, ৬০০টাকা/ঘন্টা |
|
১ বার ফসল বোনাই |
২,৪০০ |
৪ ঘণ্টা, ৬০০ টাকা /ঘণ্টা |
|
৪ কুইন্টাল বীজ |
১৪,০০০ |
৩,৫০০ টাকা/কুইন্টাল |
|
১০ বস্তা সার |
১১,০০০ |
১,১০০ টাকা/বস্তা |
|
৩ বার কীটনাশক ছড়ানো |
১২,০০০ |
৪০০০ টাকা/বার |
|
ফসল কাটা ( ৫০ জন হিসাবে) |
১৭,৫০০ |
৩৫০ টাকা /জন |
|
৫ ঘণ্টা থ্রেশর |
৬,০০০ |
১,২০০ টাকা/ঘন্টা |
|
ফসল ঘরে আনার খরচ |
১,০০০ |
৫০০টাকা/প্রতি ট্রলার |
|
অন্যান্য খরচ |
৩,০০০ |
ফসল বাজারে নেওয়া ও কুলি ভাড়া |
|
মোট খরচ |
৭১,৭০০ |
চার মাসে (১০ বিঘায় উৎপাদন ৩০ কুইন্টাল) |
|
৩০ কুইন্টাল ফসলের দাম |
৮১,০০০ |
২,৭০০ টাকা/কুইন্টাল |
|
চার মাসে নেট আয় |
৯,৩০০ |
৭৭.৫ টাকা /দিন |
তাহলে উপড়ের সারণি থেকে সহজেই বুঝতে পারছেন কৃষকদের ‘আচ্ছে দিন’। ৪ মাস সময় নিজের পরিশ্রম, মূলধন ইত্যাদি খরচ করে কৃষক পাচ্ছে মাত্র ৯,৩০০ টাকা, আরও সহজ করে বললে সেটি দাঁড়ায় ৭৭.৫ টাকা প্রতি দিনের কৃষকদের আয়। তাহলে তুলনায় দেখা যাচ্ছে একজন কৃষকের থেকে আঁকটি দিনমজুরের একদিনের আয় অনেক বেশি। অবশ্য উপরের হিসাবে প্রতিকূল পরিবেশের কথাই উল্লেখ করা হয় নি, অর্থাৎ এই ৭৭.৫ টাকা প্রতিদিন আয় কৃষক তখনি পাবে যখন পরিবেশ তাঁর চাষের অনুকূলে থাকবে, আর পরিবেশ প্রতিকূল হলে তো কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। আর ঠিক এই কারণেই কৃষক তাঁর নিজেস্ব জমি থাকা সত্ত্বেও ঋণের চোরাবালিতে ফেঁসে যায়।আপনারা বিচার করে এই বিষয়ের উপর সজাগ হোন। ভাবুন তো আজ সমস্ত কৃষক যদি ফসল উৎপাদন থেকে বিরত থাকে তাহলে আপনার পকেটে হয়তো টাকা থাকবে, কিন্তু শরীর বাঁচানোর জন্য খাবার থাকবে না।
- প্রদীপ পাল(pradip@krishijagran.com)
Share your comments