ভারতে প্রায় ১০ কোটি মহিলা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত। ভারতে গ্রামীণ এলাকার প্রায় ৮৪ শতাংশ মহিলা তাদের জীবিকা ও পারিবারিক ভরণ পোষণের জন্য কৃষি এবং সংশ্লিষ্ট কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল।
ভারতের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশের কাছে এই জন সংখ্য়া অত্য়ন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত মহিলারা নিরন্তন পরিশ্রমের মধ্য়ে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত মহিলা কৃষি শ্রমিকদের সমান মজুরির চিরন্তন প্রশ্ন এবং তার অর্ধনগ্ন উত্তর সমাজ ও সরকারের সামনে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কৃষি ব্যবস্থায় মহিলা কৃষকদের অসামান্য অবদান থাকা সত্ত্বেও তাদের মজুরি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত কোনো বিশেষ আইনি বা রাজনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করা যায়নি। কিন্তু কেন যায়নি,এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও অজানা।
আরও পড়ুনঃ international women's day 2022:দাদা একটা স্য়ানিটারি ন্য়াপকিন দিন তো!
জাতিসংঘের, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ গবেষণায় বলা হয়েছে- মহিলা কৃষকদের সম্মানজনক মজুরি এবং মহিলা কৃষক হিসেবে তাদের অধিকার, পরিবার ও সুস্থ সমাজ গঠনে এক মৌলিক উপাদান হিসাবে কাজ করে।
পরিবারের নিরাপত্তা সহ শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবিকা নির্বাহের মতো জরুরী মানবিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ঠ সক্ষম এই মহিলা কৃষকরা ৷ এর অর্থ হল-মহিলা কৃষকদের নির্দিষ্ট আয় নিশ্চিত করা মানে পুরো পরিবার ও সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন করা। কিন্তু সরকার এবং সরকারের চাটুকারিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলি এই সরল সত্য সম্পর্কে এখনও অজ্ঞ নয়।
ভারত সরকার কর্তৃক গঠিত ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন এর রিপোর্টে, মহিলা কৃষি শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে কোন তথ্য নেই – কারণ অজানা! হয়ত মহিলা কৃষকরা সংখ্য়ায় কেবল অর্ধেক বা “সামাজিক,অর্থনৈতিক,এবং মূলধারার উন্নয়নে'' (তথাকথিত) এই মহিলা কৃষকরা কোনো অবদান রাখতে পারছেন না।
তাহলে প্রশ্ন হল, আমাদের জাতীয় মহিলা কমিশনও কি মহিলা কৃষকদের সমান মজুরি পাওয়ার বিষয়কে তুচ্ছ মনে করে? নাকি সত্য়ই ধরে নেওয়া হয়েছে যে মহিলা কৃষকরা সমাজের জন্য় কোনো অবদান রাখতে পারছেন না?
তাহলে বলতেই হয়, বিগত কয়েক বছরে কৃষিক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। হুগলির নাসরিন লায়লা,বিগত কয়েক বছর ধরে প্রায় দুই হাজার মহিলাদের কৃষি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষন দিয়ে অত্মনির্ভর করে তুলেছেন। ২০২১ সালের লোকসভায় উপস্থাপিত তথ্য অনুসারে, গ্রামীণ এলাকায় কর্মরত পুরুষ শ্রমিকের থেকে মহিলা (কৃষি) শ্রমিকের সংখ্যা ব্য়পক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৮৭ -৮৮ সালে পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকের অনুপাত ছিল ৭৪.৫ এবং ৮৪.৭, যা ২০২০ সাল নাগাদ ৫৫.৪ এবং ৭৫.৭ শতাংশে দাড়িঁয়েছে।এই পরিসংখ্য়ান থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, ভারতের কৃষি ব্যবস্থা মূলত নারীদের কাঁধেই এসে পরেছে।ফলে মহিলা কৃষকদের মজুরিও আনুপাতিক হারে বেশি হওয়া উচিত ছিল- কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো।
ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশনের প্রকাশিত রিপোর্ট ২০১৭ অনুসারে, ভারতের গ্রামীণ এলাকায় কৃষি কাজে নিযুক্ত পুরুষদের গড় মজুরি ২৬৪ টাকা এবং মহিলাদের ২০৫ টাকা। অর্থাৎ কৃষিজীবী নারীদের মজুরি পুরুষদের তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ কম। লিঙ্গ সমতার সাংবিধানিক মূল্যবোধ এবং অর্থনৈতিক সমতার দিকগুলো প্রতিষ্ঠা করতে না পারার ব্য়র্থতা,সরকার ও সমাজের বহন কারা উচিত নয় কি?। কিন্তু এই ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতার জন্যও সমাজ এবং সরকারকে এই মহিলা কৃষকদের কাছে কোনও ভাবেই লজ্জিত করে না।
মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী-অধ্যুষিত শেওপুর-করাহাল অঞ্চলের গ্রামগুলি থেকে প্রতি বছর জিরার বীজ সংগ্রহ করতে জয়সালমিরে যাওয়া মহিলাদের গড় দৈনিক মজুরি মাত্র ১৬৫ টাকা। মণিপুরের থোবাল জেলায় ধানক্ষেতে ১০ ঘন্টা পরিশ্রমের জন্য মহিলা কৃষকরা মাত্র ১৭০ টাকা পান।
বিহারের কৃষি জমিতে কর্মরত শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশেরও বেশি মহিলা। কিন্তু বাস্তবতা হলো মাত্র ৪ শতাংশ নারী জমির মালিক।অর্থাৎ (সংজ্ঞা অনুসারে) কৃষক। এর অর্থ এই যে, অবশিষ্ট নারীদের অবস্থা দিনমজুরদের মতো যাদের মুষ্টিমেয় মজুরিতে পুরো পরিবারের ভরণপোষণ চলে।
আরও পড়ুনঃ National Science Day 2022: আজ জাতীয় বিজ্ঞান দিবস, কেন পালিত হয় জানেন ? জানুন এর গৌরবময় ইতিহাস
তাই এই নারী কৃষি শ্রমিকদের জমির অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদেরকে নারী কৃষকের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই হবে প্রকৃত অর্থে সমগ্র কৃষি ব্যবস্থার সবচেয়ে অর্থবহ সংস্কার।
২০১২ সালে ভারত সরকার দ্বারা গঠিত 'টাস্ক ফোর্স ফর ল্যান্ড রিফর্মস'-এর রিপোর্টে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে, গ্রামীণ এলাকায় কৃষিতে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে বিহারের মতো রাজ্যেও তাদের জমি দিতে হবে। নারীদের অধিকার দিয়ে কৃষক হওয়ার সম্মান দিতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে এটা সম্ভব হয়নি। কারন ব্য়াখ্য়া করলে পুঁথি বেড়ে যাবে। তাই এই প্রতিবেদনে এর কারন ব্য়াখ্য়া করা সম্ভব নয়।
প্রকৃতপক্ষে, মহিলা কৃষকদের মজুরি এবং তাদের ন্যূনতম আয়ের বিষয়টি কখনই ভারতীয় মূলধারার কৃষি সংস্কারের প্রাসঙ্গিক দিক হয়ে ওঠেনি। ভারতে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার সম্ভাব্য ব্যবস্থার পরামর্শ দেওয়ার জন্য গঠিত কমিটির রিপোর্টে, মহিলা কৃষি শ্রমিকদের সমান মজুরি নিশ্চিত করার বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট আইনি বা রাজনৈতিক প্রস্তাব দেওয়া হয়নি।
প্রকৃতপক্ষে, মহিলা কৃষকদের মজুরি (বা আয়) দ্বিগুণ করা একটি 'ঐতিহাসিক কৃষি সংস্কারের' দৃষ্ঠান্তমূলক পদক্ষেপ হতে পারে। ২০২২-২৩ সালের মধ্যে কৃষকদের (পুরুষ) আয় দ্বিগুণ করার পিছনে, প্রায় ১০ কোটি মহিলা কৃষকের হাত থাকবে এবং এই ক্রহ্ সত্য জানা সত্ত্বেও, মহিলা কৃষকদের বঞ্চিত করা একটি চিরন্তন প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও ২০১৯ সালে ঘোষিত 'প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি'-এর নির্ধারিত নিয়মের অধীনে সমস্ত জমির মালিক কৃষকদের বার্ষিক ৬০০০ টাকা প্রদানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর হয়ত বা অজান্তেই বেশিরভাগ মহিলা কৃষি শ্রমিককে এর বাইরে রাখা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে, মহিলা কৃষি শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত প্রশ্নের কোনো সুস্পষ্ট উত্তর না থাকার কারনে সমাজ এবং সরকারের কাছে এটি একটি শাঁখের করাত হয়ে দাড়িঁয়েছে।
Share your comments