বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক জনপ্রিয় ও সহজলভ্য একটি ফল হচ্ছে মালটা। এটি প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায় এবং দামেও বেশ সস্তা। মালটা আমাদের দেশে এখন এতোটাই জনপ্রিয় যে পথে ঘাটেও এর জুস পাওয়া যায়। কমলার তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশী হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহজেই চাষ করা যাচ্ছে। তাই প্রতিটি বসতবাড়িতে অন্য ফলের পাশাপাশি দুই-চারটি হলেও মালটার গাছ লাগানো যেতে পারে এবং এই ব্যাপারে অপরকেও উৎসাহিত করা যায়।
আসুন মালটা ফল সম্পর্কে কিছু বিস্তারিত তথ্য জানা যাক-
জলবায়ু (Climate) -
কম বৃষ্টিপাত, সুনির্দিষ্ট গ্রীষ্ম ও শীতকাল অর্থাৎ শুষ্ক ও উষ্ণ জলবায়ু মালটা চাষের জন্য উত্তম। বায়ুর আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত ফলের গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। বাতাসে অধিক আদ্রতা ও বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় মালটার খোসা পাতলা হয় এবং ফল বেশী রসালো হয়। তবে শুষ্ক আবহাওয়ায় ফলের মান ও স্বাদ উন্নতমানের হয়। আদ্র জলবায়ুতে রোগ ও ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ বেশী হয়।
মাটি (Soil) -
মালটা প্রায় সব ধরনের মাটিতে জন্মায়। তবে ছায়া পড়ে না এমন সুনিষ্কাশিত উর্বর, মধ্যম থেকে হালকা দো-আঁশ মাটি চাষের জন্য উপযুক্ত। মাটির অম্লত্ব ৫.৫ থেকে ৬.৫ হওয়া উত্তম। মালটাগাছ লবণ এবং উচ্চ তাপমাত্রা সংবেদনশীল। জলাবদ্ধতার সহ্যক্ষমতা নেই।
জাত (Variety) -
দেশি বিদেশি মালটার বিভিন্ন জাত রয়েছে। তবে এদেশে চাষ উপযোগী জাতের মধ্যে বারি মালটা-১ অন্যতম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত এ জাতটি উচ্চফলনশীল।
বারী মালটা ১।
বৈশিষ্ট্য -
নিয়মিত ফল দানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছ খাটো, ছড়ানো ও ঝোপালো। মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য চৈত্র মাস পর্যন্ত গাছে ফুল আসে এবং কার্তিক মাসে ফল খাওয়ার উপযোগী হয়। ফল গোলাকার ও মাঝারি (১৫০ গ্রাম) আকৃতির রসালো ও মিষ্টি। পাকা ফলের রং সবুজ হয়। ফলের খোসা মধ্যম পুরু ও শাসের সাথে সংযুক্ত। শাস হলুদ ভাব, রসালো, খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু। গাছ প্রতি ৩০০-৪০০ ফল ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন ২০ টন। প্রতিটি ফলের ওজন ১৭০ হতে ২০০ গ্রাম ও মিষ্টতা ১৭-২১ টি.এস.এস.। ফলে মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে ফুল আসে। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে ফল পাকে।
চেনার উপায় -
বারি মালটা -১ চেনার সহজ উপায় হলো,প্রতিটি ফলের নিচের দিকে পয়সা সদৃশ একটি গোলাকার দাগ দেখা যায়।
মালটার বংশ বিস্তার -
বীজ ও কলমের মাধ্যমে মালটার বংশ বিস্তার করা যায়। তবে বীজের চারা আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ার সাথে সমন্বয় করে বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না। তাই কলমের মাধ্যমেই চারা তৈরি করা উত্তম। তাছাড়া কলমের তৈরি চারায় মাতৃ গুন বজায় থাকে ও দ্রুত ফল ধরে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী ও বলিষ্ঠ শিকড় সমৃদ্ধ আদি জোড়ের মাধ্যমে কলম করলে গাছের জীবনকাল ও ফলন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
কলম -
বীজ ও অঙ্গজ উভয় পদ্ধতিতে মালটার বংশবিস্তার হয়। জোড় কলম (গ্রাফটিং) ও চোখ কলমের (বাডিং) মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়। জোড় কলমের জন্য রুটস্টক (আদি জোড়) নির্বাচন করতে হয়। এক্ষেত্রে বাতাবি লেবুর চারা ব্যবহার উত্তম। এরপর মাতৃগাছ হতে সায়ন (উপজোড়) সংগ্রহ করে রুটস্টকের ওপর স্থাপন করে গ্রাফটিং তৈরি করা হয়। আদি জোড়ের জন্য এক থেকে দেড় বছরের সুস্থ, সতেজ এবং সোজা চারা বেছে নিতে হবে। সায়নে অবশ্যই কমপক্ষে দুইটি চোখসহ ২/৩ ইঞ্চি লম্বা থাকা চাই। এছাড়া ডালের বয়স যেন ৮/৯ মাস হয়। সাধারণত ১০-১২ দিন পর সংযোগস্থলে জোড়া লাগে। তখন সায়নের সুপ্ত কুঁড়ি থেকে পাতা বের হয়। একাধিক ডাল বের হলে ভালোটি রেখে বাকিগুলো কেটে দিতে হবে। কলমের নিচের অংশে কোনো কুঁড়ি বা ডাল যেন না থাকে। মধ্য বৈশাখ হতে মধ্য ভাদ্র (মে-আগস্ট) গ্রাফটিং করার উপযুক্ত সময়।
চারা / কলম নির্বাচন -
চারা অবশ্যই মানসম্মত হওয়া চাই। চাষাবাদের ক্ষেত্রে অন্য সব কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হলে ও জাত নির্বাচন ভুল হলে কাঙ্খিত ফলন হবে না। তাই নিশ্চিত হয়েই চারা ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান হর্টিকালচার সেন্টার এবং বেসরকারি বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে সংগ্রহ করা উত্তম।
জমি নির্বাচন ও প্রস্তত পদ্ধতি -
সারাদিন রোদ পরে ও বৃষ্টির জল জমে না এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি মালটা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। আগাছা পরিষ্কার ও আশেপাশে উঁচু গাছ থাকলে ডালা ছেঁটে দিতে হবে।
রোপণ পদ্ধতি-
ষড়ভুজ বা বর্গাকার পদ্ধতিতে চারা বা কলম রোপণ করতে হবে। মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য ভাদ্র (মে- আগস্ট) মাস রোপণের উত্তম সময়। তবে জল বা সেচের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছর রোপণ করা যায়।
মাদা তৈরি-
চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে উভয় দিকে ৩/৪ মিটার দূরত্বে ৭৫x৭৫x৭৫ সেমি মাপে গর্ত খুড়তে হবে। প্রতি গর্তে ১৫ কেজি পচা গোবর, ৪/৫ কেজি ছাই, ২৫০গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ৫ গ্রাম বোরিক অ্যাসিড, ৫০০ গ্রাম চুন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্তে ভরে দিতে হবে। গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিন পরে চারা রোপণ করতে হবে।
চারা/ কলম রোপণ-
গর্তে সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পরে চারা/ কলম গর্তের মাঝ বরাবর সোজা করে রোপণ করতে হবে। রোপণের পর খুঁটি দিয়ে বেধে দিতে হবে। প্রয়োজন মত সেচের ব্যাবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ-
গাছের বৃদ্ধি এবং ফল ধারণের জন্য বছরে তিন বার সার দেওয়া দরকার। বর্ষার আগে মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য চৈত্রে এবং মধ্য বৈশাখ হতে মধ্য জ্যৈষ্ঠে। বর্ষার পরে মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য আশ্বিন মাসে। দুপুরবেলায় মাটিতে গাছের ছায়া যতটুকু পড়ে ততটুকু স্থানে ৬ ইঞ্চি গভীর করে ভালোভাবে কুপিয়ে সার দেওয়া উত্তম। অথবা গাছের গোড়া হতে ১ ফুট বাদ দিয়ে এরপর ৪ ফুট পরিমাণ জমি বৃত্তাকারে অনুরূপভাবে কুপিয়ে দিলেও হবে। সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হয়। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাবারের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। তাই বয়সভেদে যে পরিমাণ জৈব ও অজৈব সার দেওয়া প্রয়োজন, তা হলো-
-
১-২ বছর- গোবর ১০-১২ কেজি, ইউরিয়া ২০০-৩০০ গ্রাম, এসএসপি ১০০-১৫০ গ্রাম, এমওপি ১০০-১৫০ গ্রাম, জিংক ১০ গ্রাম ও বোরিক অ্যাসিড ৫ গ্রাম।
-
৩-৪ বছর-গোবর ১২-১৫ কেজি, ইউরিয়া ৩০০-৪৫০ গ্রাম, এসএসপি ১৫০-২০০ গ্রাম, এমওপি ১৫০-২০০, জিংক ১৫ গ্রাম ও বোরিক অ্যাসিড ৮ গ্রাম।
-
৫-৭ বছর- গোবর ১৫-১৮ কেজি, ইউরিয়া ৪৫০-৬০০ গ্রাম, এসএসপি ২০০-৩০০ গ্রাম, এমওপি ২০০-২৫০ গ্রাম, জিংক ২০ গ্রাম ও বোরিক অ্যাসিড ১০ গ্রাম।
-
৮-১০ বছর-গোবর ১৮-২০ কেজি, ইউরিয়া ৬০০-৭০০ গ্রাম, এসএসপি ৩০০-৪৫০গ্রাম, এমওপি ২৫০-৩০০ গ্রাম, জিংক ২৫ গ্রাম ও বোরিক অ্যাসিড ১২ গ্রাম।
-
১০ এর বেশী-গোবর ২০-২৫ কেজি, ইউরিয়া ৭৫০ গ্রাম, এসএসপি ৫০০ গ্রাম, এমওপি ৪৫০ গ্রাম, জিংক ৩০ গ্রাম ও বোরিক অ্যাসিড ১৫ গ্রাম।
আরও পড়ুন - Banana farming, agri-textile bag: এগ্রি টেক্সটাইল ব্যাগেই দাগহীন কলা চাষে অভাবনীয় সাফল্য
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকেরা মালটা চাষ করে সফল হচ্ছেন। বাংলাদেশের চিটাগাং –এর অধিবাসী সুনীল বরন তালুকদার উপরোক্ত বর্ণিত পদ্ধতিতে এই ফলের চাষ করে প্রায় লক্ষাধিক উপার্জন করছেন। মালটা চাষে তাঁর এই সাফল্য স্থানীয় কৃষকদের চাষে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। এই লাভজনক ফলটির চাষ করে আমাদের রাজ্যের কৃষকরাও সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে পারেন। প্রধান ফসলের সাথে এই ফসলের চাষ করে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা তাদের আয় বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারেন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে মিশ্র ফসল চাষ করলে আমাদের রাজ্যের কৃষকদের আয়ের পথ সুগম হবেই, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
আরও পড়ুন - ধানের পর তরমুজ চাষে ব্যাপক সাফল্য ওড়িশার মহিলা কৃষকের
Share your comments