পশ্চিমবঙ্গে যে ডাল শস্যের উৎপাদন হয় তা মোট চাহিদার মাত্র ১৫.২০ শতাংশ মেটাতে সক্ষম। অনেক সময় ডালের ঘাটতি মেটাতে অন্য রাজ্য থেকে ডাল শস্য আমাদের আমদানি করতে হয়। তাই আমাদের রাজ্যে ডাল শস্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অন্যতম পন্থা হলো আমন ধানের জমিতে পরবর্তী ফসল হিসাবে ‘পায়রা’ পদ্ধতিতে ডাল শস্য চাষ, যার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।
ধানের পতিত জমিতে ডালশস্যের ফলন বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য -
১) উপযুক্ত সময়ে পাকে এমন উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্যবহার করা।
২) চাষের উপযুক্ত যন্ত্র, বপন পদ্ধতি, উচ্চ বীজের হার, সঠিক সময়ে চাষ ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজশোধন একান্ত জরুরী।
৩) বীজ বোনার ৭ দিন আগে সাফ (কার্বেন্ডাজিম + ম্যানকোজেব) @ ৩ গ্রা/কেজি বীজের সাথে ভালো করে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।
৪) বীজ শোধনের জন্য আমরা জৈব ছত্রাকনাশকও ব্যবহার করতে পারি। এক্ষেত্রে ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি @ ৪-৫ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে শোধন করতে হবে বীজ বোনার দিন।
৫) বীজ বোনার আগে ২% পটাশিয়াম ডাই হাইড্রোজেন ফসফেট (kH2PO4) দ্রবণে (২০ গ্রাম kH2PO4 প্রতি লিটার জলে ভালো করে গুলে) প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা সময় ধরে বীজ ভালো করে বীজের অঙ্কুরোদগম তাড়াতাড়ি ও ভালোভাবে হয়।
৬) সাধারণত প্রাথমিক সার হিসাবে নাইট্রোজেনঘটিত সার প্রয়োগ করা হয় না। কিন্তু গাছের বৃদ্ধি ভালো না হলে, বীজ বোনার ২০-২৫ দিন পর বিঘা প্রতি ৬ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করা যাবে।
৭) এই সময় কিছু পরিমাণ সিঙ্গেল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করলে ডালশস্যের ফসফেট ও সালফারের চাহিদা মিটে যায়।
৮) ডালশস্যের ফুল ফোটার ৭-১০ দিন আগে ইউরিয়া @২% (২০ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) বা DAP @২% বা তরল মার (NPK ১৯:১৯:১৯) @৭.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে দ্রবণ তৈরি করে গাছের পাতায় প্রথম স্প্রে করা দরকার, হেক্টর প্রতি ৭০০-৮০০ লিটার দ্রবণ লাগে।
৯) একইভাবে শুঁটি আসার সময় দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে।
১০) সাধারণত অ্যাসিডিক মাটিতে বোরন ও মলিবডেনাম –এর ঘাটতি থাকে। এক্ষেত্রে বোরাক্স @২ গ্রাম ও অ্যামোনিয়াম বা সোডিয়াম মলিবডেনাম @ ০.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে ফুল আসার আগে গাছের পাতায় স্প্রে করলে ভালো ফলন সম্ভব।
১১) মাটিতে সালফারের ঘাটতি থাকলে পটাশিয়াম সালফেট ১.২৫% (৫০ গ্রাম ৪ লিটার জলে) বা ১% অ্যামোনিয়াম সালফেট দ্রবণ আলাদাভাবে বা মলুবোর/সোহাগায় দ্রবণের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
১২) মাটিতে জিঙ্কের অভাব ঘটলে, ০.৫% জিঙ্ক সালফেট এবং ০.২৫% চুন সহযোগে পাতায় স্প্রে করতে হবে ৩৫-৪০ দিনের মাথায়।
১৩) মাটিতে রসের টান হলে প্রয়োজন অনুযায়ী গাছের ফুল অবস্থায় ও শুঁটি ধরার সময় জলসেচ প্রয়োগ করতে পারলে ফলন অবশ্যই বাড়বে। জল স্প্রে করতেও পারি। স্প্রে করার জন্য হেক্টর প্রতি ৭০০-৮০০ লিটার জল ব্যবহার করতে হবে।
১৪) আগাছা দমন করতে হবে। পুনরায় ধান গাছের গোড়া থেকে যাতে ধান গাছের জন্ম না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজন হলে পোস্ট এমারজেন্সি আগাছানাশক হিসাবে Quizalofop ethyl প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ২৫-২৭ দিনের মাথায় একবার হাত নিড়ান দিয়ে আগাছা তুলে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
১৫) রোগ – পোকামাকড় দমনে IPM মডেল অনুসরণ করতে হবে।
১৬) প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য উদ্ভাবনী চাষি (Innovative farmer) –এর সংখ্যা বাড়াতে হবে।
ধানের পতিত জমিতে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা -
১) উন্নত মানের ও উন্নত জাতের বীজের অভাবের দরুন প্রস্তাবিত উচ্চফলনশীল জাতের পরিবর্তে চাষীভাইয়েরা কম ফলনশীল স্থানীয় জাতের চাষ করতে বাধ্য হচ্ছে।
২) দেরিতে বীজ বোনার জন্য ফলন কম হয়।
৩) রোগ - পোকা দমনের ব্যবস্থা না করা।
৪) সঠিকভাবে আগাছা দমন সার ও জলসেচ প্রভৃতির পরিচর্যা না হওয়া।
৫) সঠিক শস্যপর্যায় অবলম্বন না করা।
৬) পতিত জমিতে চাষ এ কৃষক বন্ধুদের অনীহা।
ফলন -
ধানের পতিত জমিতে 'পয়রা' চাষে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ডালশস্যে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৫-১৬ কুইন্টাল ফলন পাওয়া যায়।
ধানের পতিত জমিতে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা -
আমন ধানের পরবর্তী 'পয়রা' ফসল হিসেবে ডালশস্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব উন্নতমানের জাতের বীজ, আধুনিক প্রযুক্তি ও ভালো পরিচর্যা ব্যবহার করার মাধ্যমে 'পয়রা' ফসল হিসাবে ডালশস্যের চাষ করলে এর এলাকা বাড়বে। বাড়বে ডালশস্যের যোগানের পরিমাণ। রাজ্যে ডাল শস্যের ঘাটতি মিটবে। পশ্চিমবঙ্গ ডালশস্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন - অধিক ফলনের লক্ষ্যে বোরো ধানের পরিচর্যা (Boro Paddy Crop Care)
Share your comments