পশ্চিমবঙ্গে আমন ধান ওঠার পর আলু চাষের জন্য চাষিরা অনেক কম সময় পান, তারপর বর্তমানে আমরা সকলে কোম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান তুলি যাতে ধান ছাড়া পুরো গাছই জমিতে থেকে যায়, আর এই জমি পরিষ্কার করার জন্য বেশিরভাগ কৃষকরা জমিতে আগুন ধরিয়ে দেন যাতে জমি পরিষ্কার হয়ে যায় এবং পরবর্তী ফসলের ভালোভাবে চাষ করা যায়। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে দেখলে এই মহামূল্যবান অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে কৃষকরা শুধু জমি পরিষ্কারই করছেন না তারা নিজেদের পকেটও পরিষ্কার করছেন। ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে মাটির ভিষণ ভাবে ক্ষতি হচ্ছে, অনেকের ধারনা অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে দেওয়ার পর সেই ছাই মাটিতে মিশিয়ে দিলে মাটির উন্নতি হবে। ছাই মাটির পক্ষে উপকারী ঠিকই কিন্তু সেই ছাই জমিতেই উৎপন্ন করা ঠিক নয়, আগুনের উত্তাপে মাটির সমস্ত উপকারী জীবানু ধ্বংশ হয়ে যায়, মাটির মধ্যস্থ বিভিন্ন খাদ্যোপাদানগুলি অধিক তাপের ফলে উবে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় আর জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে, জমির উৎপাদনশীলতা কমে যায়। এছাড়া এই নারা পোড়ানোর ফলে পরিবেশ প্রচন্ড ভাবে দূষিত হয় ও মানব শরীরেও ভিষণ ক্ষতি করে। ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো আইনত ভাবেও দন্ডনীয়।
মাটির ওপর ফসল অবশিষ্টাংশের উপকারী প্রভাব
- ফসল অবশিষ্টাংশ মাটির সাথে মিশে ভৌতিক কবচের কাজ করে এবং মাটিকে বৃষ্টি ও বায়ুর সরাসরি অবক্ষয় থেকে রক্ষা করে। মাটির জৈব অবাস্থার উন্নতি করে আর মাটির জল ধারন ক্ষমতাও বাড়ায়।
2) ফসল অবশিষ্টাংশের দ্বারা মালচিং করলে শীত ও গ্রীষ্মের তাপমাত্রার তারতম্য থেকে মাটিকে রক্ষা করে, বাষ্পায়ন রোধ করে মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখে।
3) মাটির পি এইচ-এর সমতা বজায় রাখতে ফসলের অবশিষ্টাংশ অনবদ্য ভূমিকা পালন করে, আম্লিক মাটিতে উচ্চ কার্বন ও নাইট্রোজেন অনুপাত সম্পন্ন অবশিষ্টাংশ হাইড্রক্সিল আয়ন ত্যাগের করে পি এইচ বাড়ায়, এবং ক্ষারিয় মাটিতে নিম্ন কার্বন ও নাইট্রোজেন অনুপাত সম্পন্ন অবশিষ্টাংশ দ্বারা পি এইচ কমায়।
4) ফসল অবশিষ্টাংশ মাটির সাথে মিশে মাটির মধ্যস্থ উপকারি জীবাণু পোষণে সাহায্য করে এবং তাদের পরিমান বাড়ায়, যার ফলে গাছের গ্রহন যোগ্য খাদ্যোপাদানের পরিমান বাড়ে এবং মাটি উর্বর হয়। এছারাও ফসল অবশিষ্টাংশ মাটির মধ্যে এনজাইমের ক্রিয়াকলাপও বাড়ায় যেমন- ইউরেজ, ডিহাইড্রোজিনেজ এবং অ্যালক্যালাইন ফসফেটেজ ইত্যাদি।
ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাব
- খাদ্যোপাদানের ক্ষতি: আনুমানিকভাবে দেখাগেছে ১ টন ধানের খড় পোড়ালে ৫.৫ কেজি নাইট্রোজেন, ২.৩ কেজি ফসফরাস, ২৫ কেজি পটাশ ও ১.২ কেজি সালফারের ক্ষতি হয় এছাড়া জৈব কার্বনের ক্ষতি তো হয়েই। যেকোন ফসলের অবশিষ্টাংশের মধ্যে সাধারনত ৮০% নাইট্রোজেন,২৫% ফসফরাস, ৫০% সালফার এবং ২০% পটাশিয়াম থাকে।
- মাটির বৈশিষ্টের ওপর প্রভাব: ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় তার ফলে মাটির মধ্যস্থ উপকারী জীবানু গুলি মারা যায়, এবং ক্রমাগত পড়ানোর ফলে সমস্ত জীবানুর সংখ্যা কমে যায় আর মাটির প্রথম ১৫ সেমি স্তরে কার্বন ও নাইট্রোজেন নষ্ট হয়ে যায় যা গাছের বৃদ্ধির জন্য আবশ্যক।
- গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন: অনুমান করা হয় যে ধানের খড় পোড়ালে তার মধ্যস্থ কার্বন, কার্বন ডাই অক্সাইড রূপে নির্গমন হয় (৭০% কার্বন থাকে) , কার্বন মনো অক্সাইড (৭%) এবং মিথেন (০.৬৬%), এছাড়া খরে ২.০৯ % নাইট্রজে্ন থাকে যা নাইট্রাস অক্সাইড রুপে নির্গমন হয়। এই গ্যাস গুলিকে গ্রিনহাউস গ্যাস বলা হয়, যারা পরিবেশের ভীষণ ভাবে ক্ষতি করে, এরা বায়ুমন্ডলের ওজন স্তরে ফুটো করে দেয় যার ফলে সুর্যের অতি বেগুনী রশ্মি পৃথীবিতে আসে এবং পৃথীবির তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, যাকে আমরা বিশ্ব-উষ্ণায়ন বলি।
উপসংহার: পশুখাদ্য, জ্বালানী এবং বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ফসলের অবশিষ্টাংশ যথেষ্ট। এর বেশিরভাগই অর্থিনৈতিক ভাবে ব্যবহার হয় না, বর্জ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। চাষবাসের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা এবং অনিহার কারণে কৃষি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর মনোযোগ সিমিত। মানুষ, গবাদি পশু, মাটির স্বাস্থ্য, জীব-বৈচিত্র, পরিবেশ ইত্যাদির ওপর ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর নেতিবাচক প্রভাবের ওপর আলকপাত না করলে, ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা ফলস্বরূপ হবে না।
তথ্য : সংগৃহীত
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)
Share your comments