সাম্প্রতিক কালের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, অবহেলায় বেড়ে ওঠা বকফুলে এমন অনেক রসদ আছে যা মানুষ এতদিন পরখ করে দেখেনি। অথচ অঞ্চল বিশেষে এইসব অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছেদের মূল্য অনেক। বিভিন্ন জায়গায় মানুষ নিজেদের জীবনযাপনের সাথে জড়িয়ে নিয়েছেন এই গাছগুলোকে। আর তাই আজও এইসব গাছেদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায়নি। বকফুল গাছ যেমন বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন মাটিতে নিবদ্ধীকরন (Nitrogen fixation) করে মাটির গুনগত মান বাড়ায়, তেমনই সুস্বাদু এই ফুল পুস্টিগুণের আধার। বকফুল তাই প্রকৃত অর্থেই “রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী”। স্বাভাবিক ভাবেই বিজ্ঞানীরা এইসব অবহেলায়, অযত্নে লালিত হওয়া গাছগুলিকে ‘Development Opportunity Crops’ হিসেবে নামাঙ্কিত করেছেন, যার বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় “সুযোগ্য উন্নয়নমূলক ফসল” অথবা “উন্নয়নযোগ্য ফসল”।
এই উদ্ভিদে প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে, তবে শীতের শুরুতে গাছে ফুল ধরে বেশী। তিন রকমের ফুল দেখতে পাওয়া যায়; সাদা, গোলাপি ও লাল। ফল লম্বা, প্রায় গোল, বীজপূর্ণ এবং গ্রন্থিল। বীজ থেকে সহজেই চারা হয়। গাছের বৄদ্ধি দ্রুত, এক বছরের মধ্যেই ফুল ও ফলবতী হয়।
জেনে নিন এর চাষ পদ্ধতি (Cultivation method) -
প্রয়োজনীয় জলবায়ু ও মাটিঃ
এটি নিরক্ষীয় অঞ্চলের গাছ। ২০-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং বাৎসরিক ২০০০-৪০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত এই গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সমুদ্র তল থেকে ১২০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত স্থানে খুব সহজেই এটি জন্মায়। পাহাড়ি অঞ্চলে এটিকে ছায়াপ্রদানকারী গাছ হিসেবে লাগানো হয়। যেসব অঞ্চল প্রায় নয় মাস শুষ্ক এবং খরা প্রবণ থাকে সেখানে এই গাছ লাগিয়ে খুব দ্রুত জমিকে সবুজ আচ্ছাদনে ঢেকে ফেলা যায়। এই গাছ শৈত্যতা কমবেশী সহ্য করতে পারলেও তুষারপাত একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
বকফুল গাছ বেলে, দোআঁশ, অনুর্বর, লবণাক্ত, ক্ষারীয়, আম্লিক যেকোনো মাটিতে খুব সহজেই জন্মায়, কিন্ত মাটির ধরনের ওপর গাছের বৃদ্ধি নির্ভর করে। তবে এটিকে রাস্তার ধারে, ধান জমির আল বরাবর, খোলা জায়গায় লাগানো যেতে পারে।
বকফুলের উল্লেখযোগ্য জাতঃ
বকফুল সাদা, লাল ও গোলাপি এই তিন ধরনের পাওয়া যায়। লাল জাতের বকফুল এসেছে থাইল্যান্ড থেকে। আমাদের দেশে স্থানীয় জাত এবং থাই জাতের বকফুলের চাষ লক্ষ্য করা যায়। সাদা বকফুলই সাধারণত ভোজ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে লাল বা গোলাপি বকফুল প্রধানত বাগিচা সৌন্দর্যায়ন এ কাজে লাগে।
চারা তৈরি ও মূল জমিতে প্রতিস্থাপনঃ
বীজ এবং গাছের মোটা বা বয়স্ক ডাল দুটি থেকেই এই গাছ জন্মায়। শরত-হেমন্ত কালে ফোটা ফুলের বীজ হয় বসন্তে। বীজ গাছ থেকে সংগ্রহের পরপরই বীজতলায় লাগিয়ে ফেলতে হবে, কারন এই বীজ বেশী দিন রাখলে সেখান থেকে চারা তৈরি হয় না। বীজতলা ছাড়া পলিব্যাগেও চারা তৈরি করা যায়। ১.৫-২ মাস এর চারা গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে মূল জমিতে প্রতিস্থাপন করার আদর্শ সময়। ২ মিটার অন্তর ৩০×৩০×৩০ ঘন সেন্টিমিটার গর্ত করে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈবসার দিয়ে চারাগুলিকে লাগাতে হবে। গাছগুলি যেহেতু অনেক খোলা ডালপালার হয় তাই গাছ থেকে গাছের দূরত্ব একটু বেশী রাখা হয়। এই গাছ দ্রুত বর্ধনশীল তাই ঠিকমত যত্ন নিলে এই চারাগাছ ৭ থেকে ১০ মাস অথবা সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে ফুল ধরা শুরু করে দেয়।
আরও পড়ুন - পোকার আক্রমণে পেঁয়াজ ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? জানুন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ (Onion Crop Pest Management)
জলসেচ (Irrigation) -
এটি প্রধানত বৃষ্টির জলেই বড় হয়। যদিও এটি খুব সহজেই শুষ্ক অঞ্চলে জন্মায় এবং খরা সহ্য করতে পারে, তাও শুষ্ক সময়ে জলের ব্যবস্থা করতে পারলে গাছের বৃদ্ধি তরান্বিত হয়।
পরিচর্যা (Crop Care) -
যদিও এই গাছ প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত বাঁচে, তথাপি অধিক ফলনের জন্য প্রতি তিন বছর নতুন গাছ প্রতিস্থাপনই শ্রেয়। গাছের ভালো ফলনের জন্য বছরে অন্ততপক্ষে একবার ডালপালা ছাঁটাই করা দরকার। এতে গাছ অনেক বেশী ঝাঁকালো হয় এবং স্বভাবতই অনেক বেশী ফুল পাওয়া যায়।
ফলন -
মাটি, সামগ্রিক পরিচর্যা ও গাছের বয়সের ওপর নির্ভর করে প্রতিবছর প্রতিটি গাছ থেকে মোটামুটি ১০০-৫০০ টি ফুল ও ২৭ কেজি পর্যন্ত সবুজ পাতা পাওয়া যায়।
Share your comments