কৃমি সারাবছর জমিতে থাকলেও শীতকাল ছাড়া বাকি সময় এদের আক্রমণ বেশী হয়। তবে, আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের চারিত্রিক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা গেছে। এখন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সকল কালের ফসলেই ব্যাপক কৃমির আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এখানে আমরা পশ্চিমবঙ্গে ফসলের উদ্ভূত কৃমি সমস্যা ও তার প্রতিকার সম্বন্ধে আলোচনা করব।
শস্য উৎপাদনে সূত্রকৃমি (নিমাটোড্) বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক সমস্যা- এ বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ নেই। শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর যে বহুবিধ অন্তরায়- এর আমরা প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হই, তার মধ্যে সূত্রকৃমিও একটি প্রধান স্থান দখল করে নিয়েছে। সূত্রকৃমি জনিত সমস্যা আগেও ছিল, এখনও আছে তবে, এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে (আবহাওয়ার পরিবর্তন, নিবিড় শস্য চাষ, একই গোত্রের ফসল বারবার চাষ ইত্যাদি) এদের আক্রমণের মাত্রা কিছু ফসলে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আবার, পোষক গাছের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে কিছু ক্ষেত্রে।
সমগ্র বিশ্বে কৃমি আক্রমণে ফসলের ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১২ শতাংশ, উন্নত দেশে যার পরিমাণ আনুমানিক ৯ শতাংশ ও উন্নয়নশীল দেশে আনুমানিক ১৫ শতাংশ। ভারতবর্ষে কৃমি আক্রমণে প্রতি বছর প্রায় ২১০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়। সুতরাং, কৃষকদের আর্থিক উন্নতির লক্ষ্যে অবিলম্বে এই কীট দমন করা আবশ্যক।
সব্জি ফসলের কৃমির আক্রমণের সুসংহত প্রতিকার ব্যবস্থাপনা (Pest Management) -
ক) বীজতলা পরিচর্যা -
-
বীজতলার মাটি কর্ষণ করার পর ২৫ µm –এর স্বচ্ছপ্লাস্টিকের চাদর দিয়ে ৩-৪ সপ্তাহ ঢেকে রাখতে হবে। যা, বীজতলার মাটিকে কৃমিমুক্ত করতে সাহায্য করবে।
-
কৃমিমুক্ত চারা তৈরীর জন্য বীজতলার মাটি সুন্দরভাবে চাষ দেওয়ার পর ধানের তুঁষ প্রতি বর্গমিটারে ২০ কেজি হিসাবে দিয়ে ঢেকে ফেলতে হবে। অতঃপর আগুন লাগিয়ে দিন। এরপর তুঁষ থেকে পাওয়া ছাই মাটির সাথে মিশিয়ে দিন ও এক সপ্তাহ পর বীজ বপন করুন।
-
বীজতলার মাটিতে রাসায়নিক কৃমিনাশক হিসাবে কার্বোফিউরান ৩ জি ১০ গ্রাম বা ফোরেট ১০ জি ৩ গ্রাম বা কারটাপ হাইড্রোক্লোরাইড ৪ জি ৭.৫ গ্রাম প্রতি বর্গমিটারে প্রয়োগে কৃমিমুক্ত চারা তৈরী করা যায়।
খ) বীজ শোধন-
-
জৈব কৃমিনাশক যথা, ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি বা সিউডোমোনাসফ্লুরোসেন্স বা পারপিউরিওসিলিয়াম লিলাসিনাম ১০ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করা যেতে পারে।
-
নিম বীজের গুঁড়ো ১০ গ্রাম প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের জন্য নিয়ে সারারাত (১২ ঘন্টা) জলে ভিজিয়ে রেখে তার নির্যাস- এ বীজগুলো ২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করা যেতে পারে।
-
বীজ বোনার আগে প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের জন্য ১২ গ্রাম কার্বোসালফান ২৫ ডি.এস. গুঁড়ো পাউডার আঠার সাথে ভালোভাবে মাখিয়ে ছাওয়ায় শুকিয়ে পরের দিন লাগালে গুটি কৃমির আক্রমণ কম হয়। এছাড়া প্রতি লিটার জলে ২ মিলি হিসাবে কার্বোসালফান ২৫ ই.সি. মিশিয়ে ২ ঘন্টা ডুবিয়ে রেখে অতঃপর বীজ ছাওয়ায় শুকিয়ে লাগালে কৃমিমুক্ত চারা উৎপাদন সম্ভব। কার্টাপ হাইড্রোক্লোরাইড ৫০ এস. পি. ৫০০ পিপিএম হারে ২ ঘন্টা সিক্ত বীজ শোধনের জন্যও ব্যবহার করা যায়।
গ) চারাগাছ শোধন -
বীজতলা শোধন যদি সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে মূল জমিতে চারাগাছ লাগানোর পূর্বে শিকড়কে কৃমিমুক্ত করতে প্রতি লিটার জলে কার্বোসালফান ২৫ ই.সি. ৩-৪ মিলি হিসাবে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরী করে চারাগাছের শিকড়কে ১-২ ঘন্টা ডুবিয়ে নিয়ে লাগাতে হবে। শিকড় শোধনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে গাছের পাতা ঐ দ্রবণের সংস্পর্শে না আসে।
ঘ) মূলজমি পরিচর্যা-
-
গ্রীষ্মকালীন চাষ বা কর্ষণ- গ্রীষ্মকালে জমিকে ভালভাবে ১০-১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার ১০-১৫ সেমি গভীর চাষ দিলে কৃমির সংখ্যা হ্রাস পায়।
-
ফসল চক্র- শস্য পর্যায়ে আপোষক ফসল যেমন সরিষা, তিল, ভুট্টা, গম ইত্যাদি এক বা দু’বছর পর্যায়ক্রমে চাষ করলে গুটি কৃমির উপদ্রব কম হয়।
-
শত্রু ফসলের চাষ- অন্তবর্তী বা সাথী ফসল হিসাবে আফ্রিকান গাঁদা, তিল বা শতমূলীর চাষ করলেও কৃমির সংখ্যা হ্রাস পায়।
-
ফাঁদশস্য হিসাবে শন চাষ করলে গুটি কৃমির সংখ্যা হ্রাস পায়।
গুটিকৃমি উপদ্রুত এলাকায় শীতকালে মূল শস্য চাষের আগে সর্ষপ গোত্রের ফসল যেমন সরিষা, রাই, টোরিয়া ইত্যাদি বীজ বোনার ৩-৪ সপ্তাহের মাথায় লাঙ্গল দিয়ে মাটিতে রস থাকে অবস্থায় মিশিয়ে দিলে কৃমির সংখ্যা কমে যায়। গাছে জমিতে মিশিয়ে দেওয়ায় ১৫ দিন পর মূল ফসল বোনা বা রোয়া করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন - শস্য আবর্তন কেন আবশ্যক? এর মাধ্যমে কৃষকরা কতটা লাভবান হবেন, জানুন বিস্তারিত
ঙ) সহনশীল জাত নির্বাচন -
ফসল | সহনশীল জাত | কৃমি শত্রু |
বেগুন | জায়েন্ট অফ্ বেনারস, গোলা, ব্ল্যাক বিউটি, পি.বি.আর.-৯১-২ | মেলয়ডোগাইনি |
লঙ্কা | পুসা জোয়ালা, সূর্যমুখী, এন. পি.-৪৬এ, বিশ্বসুন্দরী, মোহিনী | মেলয়ডোগাইনি |
ঢেঁড়স | বৈশালী বধূ, কাঁথি লোকাল গ্রীন | মেলয়ডোগাইনি |
কুমড়ো | দসনা, জয়পুরি | মেলয়ডোগাইনি |
তরমুজ | শাজাহানপুরি | মেলয়ডোগাইনি |
বরবটি | জি. এ. ইউ. -১, বরবটি মিউট্যান্ট, ৮১-১বি, সি-১৫২ | মেলয়ডোগাইনি |
জৈবসার প্রয়োগ-
১) নিম খোল, মহুয়া খোল বা সরিষা খোল হেক্টর প্রতি ২৫০-৩০০ কেজি হিসাবে গাছ লাগানোর এক সপ্তাহ আগে ব্যবহারে ভাল ফল পাওয়া যায়।
২) জৈব কৃমিনাশক হিসাবে পারপিউরিওসিলিয়াম লিলাসিনাম বা পোকোনিয়া ক্ল্যামাইডোস্পোরিয়া @ ৫ কেজি/হেক্টর বা নিপিট @ ১.৫ লিটার/হেক্টর বপণের ১০ দিন পরে জমিতে প্রযোগ করা যেতে পারে।
৩) রাসায়নিক কৃমিনাশক হিসাবে নিমিজ (ফ্লুয়েনসালফন ২% জি আর) @ ১.৫ গ্রাম/গাছ বা ফ্লুওপাইরাম (ভেলাম প্রাইম ৩৪.৪৮% এস সি) রোপনের ১০ ও ৩০ দিন অন্তর ৬২৫ মিলি ৩০০০ লিটার জলে মিশিয়ে প্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
শত্রু কৃমির প্রভাব থেকে মূল্যবান ফসলকে রক্ষা করতে অবশ্য করণীয়-
-
মাটি এবং উদ্ভিদই হল কৃমির আধার বা আশ্রয়স্থল। একটি জীবের জৈবিক প্রণালীর প্রকৃতি আমাদের ধারণা থেকে ভিন্ন হতে পারে। সুতরাং, বিজ্ঞানভিত্তিক যুগাপোযোগী বিষয়ভিত্তিক গবেষণার প্রয়োজন কৃমির এরূপ আচরণের সঠিক কারণ খুঁজে বের করার জন্য।
-
প্রতিকার ব্যবস্থার সঠিক রূপায়নে কৃষি বাস্তুতন্ত্র ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রক উপাদান যা, কৃমি ও তার আশ্রয়দাতা (শস্য)-কে প্রভাবিত করে তাদের মূখ্য ভূমিকা আছে।
-
কৃষি ও কৃষির সাথে যুক্ত সবাইকে সূত্রকৃমি সম্পর্কে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার।
-
প্রাকৃতিক কৃমিনাশকের ব্যবহারের জন্য জোর দিতে হবে ও সর্বোপরি এ সম্পর্কে গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আরও পড়ুন - পশ্চিমবঙ্গে আবহাওয়া ভিত্তিক ফসল চাষ, নগদ শস্য এবং ফসল শস্যের পরিচিতি
Share your comments