ওল খেতে কার না ভালো লাগে! ওলঘন্ট বা ওলের ভর্তা বাঙালি মাত্রই প্রিয়। বনে-বাদাড়ে ওল আপনাআপনি মাটির নিচে ফললেও, এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য বর্তমানে ব্যবসায়িক ভাবে এই চাষে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাজারে মানুষও ওল প্রচুর পরিমাণে কিনতে আসেন। চাষিরা বর্তমানের এই চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। চৈত্র মাস ওল চাষের সর্বোত্তম সময়। গুঁড়িকন্দ হিসাবে ওল মানুষের কাছে বিখ্যাত। ওলের গুঁড়িকন্দ গোলাকার বা লম্বাটে বিভিন্ন আকারের হতে পারে। কন্দের মাথাটা অনেকটা চাকতির মতো। ১০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত এই কন্দের ব্যাস হতে পারে। এমনও দেখা গেছে ২০ কেজি ওজনের ওলও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মাটি থেকে কন্দ না তুলে তেমনই রেখে দিলে বছর গড়ালে বড়না আকারের ওল পাওয়া যেতে পারে। ওলের মাদ্রাজি জাত সর্বাপেক্ষা উত্তম বলে বিবেচিত হয়।
চাষ পদ্ধতি (Cultivation Process)
জল দাঁড়ায় না এমন উঁচু জমি ওল চাষের জন্য আদর্শ। বেলে-দো-আঁশ মাটি ওল চাষের জন্য আদর্শ। ওল চাষের জন্য রোপণের দূরত্ব সারি থেকে সারি ৩০ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত। চারা গজানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর প্রতি শতক জমির জন্য ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম এমওপি এবং ২ কেজি এসএসপি সার মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে পিলি তৈরি করতে হবে। ওল চাষের জন্য দরকার প্রয়োজনীয় জল সেচ।
জমি তৈরী (Land Preparation)
ওলের জমি করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে চার থেকে পাঁচটি চাষ দিতে হবে। সাধারণত ওলের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব এক মিটার দেওয়া হয়। তবে চাকির আকার বা ওজন অনুযায়ী চাকি থেকে চাকির দূরত্ব প্রতি সারিতে ভিন্ন হয়। এ জন্য সংগৃহীত চাকিগুলো মোটামুটি একই আকার বা ওজনের হলে ভালো হয়। তা না হলে আকার বা ওজন অনুযায়ী চাকিগুলোকে দুই থেকে তিনটি গ্রেডে ভাগ করে জমিতে বপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন ২০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের চাকির জন্য রোপণ দূরত্ব হবে ১.৭৫ মিটার, ৪০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের চাকির জন্য ১.৯ মিটার, ৮০০ গ্রাম ওজনের ঊর্ধ্বে হলে চাকির জন্য দুই মিটার দূরত্ব দেওয়া যেতে পারে। চাকির আকার যত বড় হয় উৎপাদিত ওলের আকারও তত বড় হয়।
চাষ দেওয়া জমিতে রোপনের দূরত্ব অনুযায়ী গর্ত করতে হবে। গর্তের আকারও চাকির আকার অনুযায়ী কম-বেশি করতে হয়। ‘চাকি’ অনুযায়ী ২০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার গভীর করে গর্ত করতে হবে। গর্তের ব্যাস ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার হতে পারে। গর্তের নিচে অল্প ছাই দিয়ে তার ওপর চাকিটি বসিয়ে দিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে ‘চাকি’র মুখ যেন সোজা আকাশের দিকে থাকে। তারপর গর্ত থেকে তোলা মাটির সাথে সার মিশিয়ে দিতে হবে।
আরও পড়ুন: Bater Farming: কোয়েল পাখি পালনে দ্বিগুন অর্থ লাভ করুন
সারের মাত্রা (Fertilizer)
সারের মাত্রা একর প্রতি ৩০ কেজি ইউরিয়া, ১২০ কেজি এসএসপি, ৫০ কেজি এমওপি। প্রতি গর্তের মাটিতে কী পরিমাণ সার মিশাতে হবে তা নির্ভর করবে একর প্রতি গর্তের সংখ্যার ওপর। মোট সারের পরিমাণকে একর প্রতি গর্তের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গর্ত প্রতি সারের পরিমাণ বের করে নিতে হবে। সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। ভরাট করার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে যেন ভালো ‘জো’ থাকে। ভরাটের পর গর্তের মুখ মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু করে ঢিবির মতো করে দিতে হবে। এতে সুবিধা হলো, গর্তের মধ্যে অনেক সময় বৃষ্টির জল জমে ‘চাকি’ পচে যায়। ঢিবি তৈরির ফলে এ সম্ভাবনা কমে যায়। ‘চাকি’ থেকে মাটির ওপরে চারা বেরিয়ে আসতে বেশ সময় লাগে। তাই এ সময় সব জমি খড় বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রাখলে ভালো হয়। জমিতে সালফারের অভাব থাকলে একরপ্রতি ২০ কেজি জিপসাম সার এবং সুযোগ থাকলে ১০০ কেজি ছাই ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
পরিচর্যা (Caring)
চারা গজানোর পর চারা যাতে ভালোভাবে মাটির ওপরে পাতা ছড়াতে পারে সে জন্য কচুরিপানা বা খড় মুখের কাছে সামান্য আলগা করে ঢেকে দিতে হবে। চারা গজানোর এক মাস পর একর প্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি এমওপি সার সেচের পর গাছের চারপাশে খড় বা কচুরিপানার নিচে দিতে হবে। গোড়ার মাটি কিছুদিন পর হালকা ভাবে কুপিয়ে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে শিকড় যেন এর ফলে ক্ষতির মুখে না পড়ে।
পোকামাকড় ও রোগদমন (Disease and Pest Control)
কীটপতঙ্গ ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ ওলকচুর ক্ষেত্রে তেমন লক্ষ্য করা না গেলেও, লিম্ফ ব্লাইট কলার রট ও মোজাইক রোগে কখনো কখনো ওল আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়াও গোঁড়া পচা রোগ ওলের জন্য ভীষণই ক্ষতিকর হিসাবে বিবেচিত হয়। ওলের চাকি লাগানোর আগে ছত্রাকনাশক ব্যাভিস্টিন দিয়ে তা শোধন করে নিলে এই রোগ তেমন থাবা বসাতে পারে না।
আরও পড়ুন: Coconut Meat : নারকেলেও রয়েছে প্রচুর পুষ্টি, এর তৈরি হচ্ছে ওষুধ, জেনে নিন নারকেলের ঔষধি গুণ সম্পর্কে
Share your comments