অ্যাকোয়াপনিক্স (Aquaponics) সিস্টেম মূলত মাছ চাষ ও মাটি ছাড়া সবজি চাষের একটি সমন্বিত রূপ; একটি দীর্ঘস্থায়ী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জৈবিক সিস্টেম যা ক্ষুদ্র বা বৃহৎ যে কোনো পরিসরেই বাস্তবায়িত করা সম্ভব। পরিবেশ-বান্ধব এই পদ্ধতি অবলম্বন করে গ্রাম কিংবা শহরের বাগানীরা অতি সহজেই মাছের পাশাপাশি কীটনাশক-বিহীন রকমারি শাক-সবজি সারা বছরব্যাপী উৎপাদন করে একদিকে যেমন পারিবারিক চাহিদা পূরণ করতে পারবেন, অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিও হ্রাস করা সম্ভব হবে।
অ্যাকোয়াপনিক্স কী (What is Aquaponics) ?
অ্যাকোয়াপনিক্স হলো মাছ চাষের সাথে সাথে মাটি ছাড়াই গাছপালা ও শাক-সবজি উৎপাদন করার একটি প্রাকৃতিক কৌশল যেখানে মাছ চাষ থেকে আসা ময়লা তথা দূষিত জল গাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং সেখান থেকে উৎপন্ন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার জল পুনরায় মাছের ট্যাংকে ফিরে আসে। এখানে প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া অনুঘটক হিসাবে কাজ করে মাছের বর্জ্য থেকে গাছকে নিজের খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করে এবং মাটি ছাড়াই সবজি উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
অ্যাকোয়াপনিক্স পদ্ধতি স্থাপনের জন্য বেশ কিছু উপকরণের প্রয়োজন। যেমন- মাছের ট্যাংক, সবজির পাত্র, পাত্রে গাছ রোপণের জন্য ইটের খোয়া বা নুড়ি পাথর, জল সরবরাহের জন্য পাম্প ও পাইপ, মাছের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য এয়ারেটর, স্টোন ও টিউবিং, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য তার, সুইচ, সুইচ বোর্ড এবং সবজির পাত্র স্থাপনের জন্য মাচা।
অ্যাকোয়াপনিক্সের কার্য প্রণালী:
উঠোন বা ছাদের আয়তনের উপর নির্ভর করে যেকোন আকারের প্লাস্টিক ট্যাংক অথবা ড্রামের মধ্যে তেলাপিয়া, শিঙ্গি, মাগুর, কই, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন দেশীয় জাতের মাছ মজুত করা যায়। তবে দ্রুত বর্ধনশীল ও অধিক ঘনত্বে চাষ করা সম্ভব এমন প্রজাতিই অ্যাকোয়াপনিক্সের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। মাছের বৃদ্ধি বজায় রাখতে উৎকৃষ্ট মানের খাদ্য পরিবেশন এবং এয়ারেটরের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করে জলের গুণমান ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরী। সবজি চাষের জন্য প্লাস্টিকের ড্রাম লম্বালম্বিভাবে কেটে অর্ধেক করে মাছের ট্যাংকের পাশেই তাদের মাচায় সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করা হয়। প্রতিটি ড্রামের নীচের দিকে একটি নির্গম নল রাখা থাকে, যার মাধ্যমে ড্রাম থেকে উৎপন্ন পরিশ্রুত জল মূল নির্গম পাইপ লাইনে এসে মুক্ত হয় এবং সেখান থেকে পুনরায় তা মাছের ট্যাংকে ফিরে আসে। ড্রামের ভেতর নির্গম নলের অংশটি একটি বহুছিদ্রযুক্ত চওড়া ফিল্টার পাইপ দিয়ে ঢেকে দিলে নলের মুখ অবরুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো যায়। এরপর ড্রামে ইটের খোয়া বা নুড়ি পাথর স্তরে স্তরে সাজিয়ে তাতে টমেটো, শসা, করোলা, শিম, ব্রকলি, পুদিনা, বেগুন, লেটুস ইত্যাদি চারা রোপণ করা হয়।
অ্যাকোয়াপনিক্স পদ্ধতিতে ট্যাংকে রাখা মাছের বর্জ্য পদার্থ রূপে এবং খাদ্যের অবশিষ্টাংশ পচনের ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়। এরপর এই দূষিত জল পাম্পের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট পাইপ লাইনের মাধ্যমে প্রতিটি সবজির ড্রামে সরবরাহ করা হয়। গাছের শিকড়ে উপস্থিত বিভিন্ন নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া যেমন নাইট্রোসোমোনাস, নাইট্রোব্যাকটর জলের অ্যামোনিয়াকে ভেঙে গাছের খাদ্য উপযোগী নাইট্রেটে পরিণত করে ও জলকে দূষণ মুক্ত করে। এরপর ওই পরিষ্কার জল নির্গম পাইপ লাইনের মাধ্যমে পুনরায় মাছের ট্যাংকে ফিরে আসে, যা মাছের জন্য নিরাপদ জল হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চক্রটিই বারবার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। একদিকে মাছ যেমন ব্যাকটেরিয়ার জন্য পুষ্টি সরবরাহ করে, অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়া মাছের বর্জ্য ভেঙ্গে নাইট্রেট তৈরি করে গাছের খাদ্যের যোগান দেয়। এই ভাবেই গাছের শিকড় ও তাতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিক বায়ো ফিল্টার হিসেবে কাজ করে এবং জল পরিষ্কার করে মাছের ট্যাংকের জলের গুণমান নিয়ন্ত্রণ করে।
অ্যাকোয়াপনিক্সের সুবিধা :
১. এটি অত্যন্ত সহজ প্রযুক্তি ও সম্পূর্ণ পরিবেশ-বান্ধব।
২. অ্যাকোয়াপনিক্স কোন বর্জ্য উৎপাদন করে না।
৩. এটি একটি জৈব খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি হওয়ায় পুষ্টিকর ফসল উৎপাদন করা যায়।
৪. এই পদ্ধতিতে সারা বছরই মাছ ও সবজি চাষ করা সম্ভব।
৫. এই পদ্ধতিতে জলের কোন অপচয় হয় না, শুধু বাষ্পায়িত এবং গাছে শোষণকৃত জল ট্যাংকে নিয়মিত যোগ করতে হয়।
৬. মাটি ব্যবহৃত না হওয়ায় মাটি বাহিত রোগ-বালাই উৎপাদিত সবজিতে আসতে পারে না, ফলে রোগের উপদ্রপ বেশ কম হয়।
৭. এই সিস্টেমে ইটের খোয়া বা নুড়ি পাথরের মধ্যে সবজি ফলানো হয়, তাই আগাছাও জন্মায় না এবং তা পরিষ্কার করার দরকারও হয় না।
৮. এই পদ্ধতিতে কৃষিকাজে অনুর্বর এবং পতিত জমির সদ্ব্যবহার সম্ভব।
৯. প্রাথমিক ভাবে অ্যাকোয়াপনিক্স সিস্টেম তৈরী করা কিছুটা ব্যয় সাপেক্ষ হলেও, পরবর্তী উৎপাদন ব্যয় অত্যন্ত কম।
১০. যে কোন এলাকায় ও যে কোনো আবহাওয়ায় এটি করা সম্ভব।
আরও পড়ুন - Safeda Farming- সবেদার জাত পরিচিতি এবং চাষ পদ্ধতি
গ্রামীণ বা শহরাঞ্চলে অ্যাকোয়াপনিক্স পদ্ধতি এখনও তেমন ভাবে জনপ্রিয় না হলেও অদূর ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি যে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় তা নিশ্চিত করে বলা চলে। কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলেই এই পদ্ধতিতে সাফল্য আসবেই। এগুলি হলো -
১. নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
২. এটি একটি প্রযুক্তি-নির্ভর পদ্ধতি, তাই এ সম্পর্কে ভালো ভাবে জেনে তবে শুরু করতে হবে।
৩. যন্ত্রপাতি সময়মত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরীক্ষা করতে হবে।
৪. মাছকে ঠিক মতো খাবার দিতে হবে।
৫. মাছ ও সবজি দ্রুততম সময়ে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সুতরাং, আধুনিক কৃষি ক্ষেত্রে একটি মজবুত খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই সমন্বিত কৃষি প্রযুক্তি হয়ে উঠতেই পারে অন্যতম প্রধান বিকল্প।
আরও পড়ুন - Marigold Farming – গাঁদা ফুলের জাত ও লাভজনক চাষ কৌশল
Share your comments