মাছ অত্যন্ত পচনশীল দ্রব্য। তাই এর পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে, পচন থেকে রক্ষা করতে মাছ ধরার পরে দ্রুত সংরক্ষণ দরকার। সঠিক সংরক্ষণের অভাবে বাজারে মাছের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়, চাষীরা যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এদিকে ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে সংরক্ষিত মাছের চাহিদা বাজারে একেবারেই কম। তাই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাছ সংরক্ষণ করলে উৎপাদন-পরবর্তী অপচয় যেমন কমবে, পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষীদের ক্ষতির আশঙ্কাও কমবে।
সংরক্ষণে ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলির মূলনীতি হল - পচনকারী অণুজীব থেকে মাছকে দূরে রাখা, অণুজীবের বৃদ্ধি ও কার্যকলাপকে বিঘ্নিত করা, মাছের দেহ থেকে ব্যবহারোপযোগী জল অপসারণ করে অণুজীব ধ্বংস করা।
মাছের সংরক্ষণে নিচের পদ্ধতিগুলো সহজেই অনুসরণ করা যায়।
১. শুকিয়ে মাছ সংরক্ষণ বা শুঁটকিকরণ (Drying) :
এটি একটি অতি প্রাচীন পদ্ধতি। প্রাকৃতিক পরিবেশে সূর্যালোক ও বাতাসের মাধ্যমে মাছের দেহ থেকে অতিরিক্ত জল বের করে দিয়ে শুকনো করাকে শুঁটকীকরণ বলে। প্রায় সব ধরনের মাছই শুঁটকী করা যায়। ছোট মাছ যেমন- পুঁটি, মৌরলা, চাঁদা, চেলা, কাচকি ইত্যাদি শুঁটকী করার জন্য প্রথমে ভালো করে জলে ধুয়ে পেটে আঙুল দিয়ে টিপে নাড়িভুঁড়ি বের করতে হয়। এরপর আবার জলে ধুয়ে ১০ শতাংশ লবণ জলে ১৫-২০ মিনিট রেখে চাটাই বা টিনের ওপর ছড়িয়ে দিলেই সাধারণত কড়া রোদে ৪-৫ দিনে শুকিয়ে সংরক্ষণ করার উপযোগী হয়। বড় মাছ শুঁটকিকরণের ক্ষেত্রে আঁশ, লেজ, পাখনা, নাড়িভুঁড়ি, ফুলকা ইত্যাদি অপসারণ করে মাথার পর থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত আড়াআড়ি ভাবে কয়েক জায়গায় চিরে দিতে হয়। কাঁচা মাছগুলো প্রথমে চাটাই বা টিনের ওপর রোদে ৩-৪ দিন শুকানোর পর কিছুদিন ঝুলিয়ে শুকাতে হয়। এভাবে বড় মাছ শুকাতে ৮-১০ দিন সময় লাগে। সাধারণভাবে সম ওজনের কাঁচা মাছের থেকে শুঁটকির পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। এতে প্রোটিন ৬০-৮০%, ফ্যাট ৮-২০% ও জলের পরিমাণ ১০-২০% হয়। বায়ু নিরোধক পাত্রে শুকনো স্থানে সঠিক উপায়ে মজুত করলে বেশ কিছুদিন অবধি এর গুণমান ভালো রাখা সম্ভব।
২. লবণজাতকরণ (Salting) :
মাছ সংরক্ষণের এটি একটি সহজ পদ্ধতি। এতে মাছের দেহে সাধারণ লবণ প্রবেশ করানোর ফলে দেহ থেকে জল বেরিয়ে গিয়ে লবণের ঘনত্ব বেড়ে যায়, যা অণুজীবের জন্ম ও বৃদ্ধি ব্যাহত করে। এই পদ্ধতিতে দেহের আঁশ, পাখনা ও নাড়িভুঁড়ি ফেলে দিয়ে মাছের পিঠের দিক থেকে বুক পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে কয়েকটি জায়গায় চিরে দেওয়া হয়। তারপর দেহের বাইরে ও ভেতরে হাত দিয়ে কয়েকবার ঘসে ভালোভাবে লবণ মাখিয়ে দিতে হয়। লবণ মিশ্রিত মাছগুলো বাঁশের ঝুড়ি বা কাঠের পাটাতনের ওপর স্তরে স্তরে সাজিয়ে প্রতি স্তরে হালকা লবণের ছিটা দিয়ে ১০-১৫ দিন ঢেকে রাখতে হয়। জল ঝরে গেলে লবণজাত মাছগুলো টিনের কৌটোয় রেখে গুদামজাত করা যায়। এই উপায়ে ইলিশ মাছ খুব সহজেই সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
৩. বরফজাতকরণ (Icing) :
এটি একটি স্বল্পকালীন সংরক্ষণ পদ্ধতি। বরফ ব্যবহার করে মাছের দেহের তাপমাত্রা ০°-৩° সে. অবধি নামিয়ে আনা যায়। ফলে ব্যাকটেরিয়া যেমন সংক্রমণ ঘটাতে পারে না, তেমনি উৎসেচকের ক্রিয়া বিলম্বিত হয় ও সার্বিক ভাবে পচন রোধ করা যায়। তাপের কুপরিবাহী পাত্রে একস্তর মাছ একস্তর বরফ দিয়ে সাজিয়ে বাক্স ভর্তি করে ঢাকনা আটকে দিলে প্রায় ১০-১৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এক্ষেত্রে মাছের স্বাদ ও গন্ধ টাটকা মাছের মতো থাকে। শীতকালে বরফ ও মাছ ১:১ অনুপাতে এবং গ্রীষ্মকালে ২:১ অনুপাতে ব্যবহার করতে হয়। বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁশের ঝুড়ি বা অন্য কোনো পাত্রে একস্তর বরফ ও একস্তর মাছ সাজিয়ে মুখ আটকে দিলে ২-৩ দিন পর্যন্ত মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব।
৪. হিমায়িতকরণ (Freezing):
এই পদ্ধতিতে খুব নিম্ন তাপমাত্রা ব্যবহার করে মাছের দেহের প্রায় সম্পূর্ণ জলীয় অংশ বরফে পরিণত করা হয়। ফলে অণুজীবের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মাছের গুণগত মান সংরক্ষিত হয়। প্রথমে মাছের নাড়িভুঁড়ি, আঁশ, পাখনা ইত্যাদি ফেলে দিয়ে পরিষ্কার জলে ধুয়ে ১০ পিপিএম ক্লোরিন জলে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। এরপর ফ্রিজারে -৩৫° থেকে -৪০° সে. তাপমাত্রায় ৪-৫ ঘণ্টা হিমায়িত করার পর সঠিক উপায়ে প্যাকিং করে -১৮° থেকে -২০° সে. তাপমাত্রায় গুদামজাত করা হয়। কন্ট্যাক্ট প্লেট ফ্রিজারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মাছ ও চিংড়ি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সারাবছর হিমায়িত করা হয়।
৫. ধূমায়িতকরণ (Smoking) :
বাণিজ্যিকভাবে ধূমায়নের জন্য চিমনি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে মাছ ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব। মাছের দেহ থেকে আঁশ, পাখনা, লেজ, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি ফেলে দিয়ে ৬০-৭০ শতাংশ লবণ দ্রবণে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। তারপর চিমনির মেঝেতে কাঠের গুঁড়ো পুড়িয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে মাছগুলো তার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়। চিমনির বহির্গমন পথ বন্ধ থাকায় ভিতরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং উচ্চ তাপমাত্রা ও ধোঁয়ার কণা একত্রে মাছের দেহ থেকে জল অপসারণ করে ও মাছগুলির বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এভাবে ১০-১২ ঘণ্টা ধূমায়িত করলে মাছের দেহের জলের পরিমাণ প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ কমে যায়।
৬. ক্যানিং বা টিনজাতকরণ (Canning) :
মাছ টিনজাতকরণ সংরক্ষণের এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে মাছকে সম্পূর্ণরূপে বায়ুশূন্য পাত্রে আবদ্ধ করে অতি উচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রথমে মাছের মাথা, পাখনা, আঁশ, নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করে নির্দিষ্ট মাপমতো টুকরো করার পর টুকরোগুলো লবণ দ্রবণে সিদ্ধ করে ঠাণ্ডা করে নেওয়া হয়। এবার সিদ্ধ মাছগুলো জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টিনের কৌটোয় স্তরে স্তরে সাজিয়ে প্রতি স্তরে বিভিন্ন রকম মসলা, তেল, সস, লবণ ইত্যাদি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। টিনের কৌটোর উপরের দিকে একটু ফাঁকা স্থান রেখে মেশিনের সাহায্যে বায়ুশূন্য করে কৌটোর মুখ বন্ধ করা হয়। এরপর সোডিয়াম ফসফেট মিশ্রিত গরম জলে কৌটোর বাইরের দিক ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিয়ে ১২১° সে. তাপমাত্রায় ৫০-৬০ মিনিট উত্তপ্ত করা হয়। অবশেষে পাত্রটি ঠাণ্ডা করে গায়ে লেবেলিং করে -১৮° থেকে -২০° সে. তাপমাত্রায় মজুত করা হয়। এইভাবে সংরক্ষিত মাছের গুণগত মান প্রায় ২-১০ বছর পর্যন্ত ভালো রাখা যায়।
আরও পড়ুন - Biofloc fish farming: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ কতটা লাভজনক?
সুতরাং, বিজ্ঞানসম্মত মাছ চাষের পাশাপাশি তার স্বাস্থ্যসম্মত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ আধুনিক মৎস্যচাষের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন - Sorghum cultivation: জেনে নিন জোয়ার চাষের সহজ পদ্ধতি
Share your comments