বকফুল একটি শিম্বী বা মটর গোত্রীয় উদ্ভিদ, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Sesbania grandiflora। এটি ফ্যাবেসি (Fabaceae) পরিবার ও ফ্যাবয়ডি (Faboidae) উপ-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পোশাকি নাম বকফুল, আগাথি, হামিং বার্ড ট্রি, ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান পি, গাছমুঙ্গা (হিন্দি) ইত্যাদি। বাংলার প্রকৃতিতে এই গাছ বহু পুরনো। এমনকি প্রাচীন সাহিত্য, রাজনিঘন্টু ও ভারতচন্দ্রের কবিতাতে ও এর উল্লেখ পাওয়া যায়; “অশোক-কিংশুক মধুটগর/ চম্পক পুন্নাগ নাগকেশর/ গন্ধরাজ যুতি ঝাটি মনোহর/ বাসক বক শেফালিকা”।’
বকফুলের আদি নিবাস মালয়েশিয়া। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বকফুল গাছ জন্মায়। বিশেষ করে থাইল্যান্ড, লাওস, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চিন, কম্বোডিয়া, ফিলিপিন্স ইত্যাদি দেশে এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে কিউবা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশেও এই গাছ জন্মাচ্ছে। বিগত প্রায় দেড়শ বছর ধরে পশ্চিম আফ্রিকাতেও এর চাষ করা হচ্ছে।
শিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদ হওয়ায় এই গাছ বাতাস থেকে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন গ্যাস শোষণ করে ও মাটিতে সঞ্চয় করে। তাই সবুজ সার (Green manure) হিসেবে একে ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলত, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় ও মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে বকফুল গাছ সবুজ সার বা ফসল হিসেবে চাষ করে মাটিতে মিশিয়ে দিলে হেক্টর প্রতি প্রায় ৫৫-৬০ কেজি নাইট্রোজেন যোগ হয়।
গাছ একটু পুরনো হলে তার থেকে ডালপালা কেটে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ভূমিক্ষয় প্রতিরোধে, আদা ও হলুদের জমিতে ছায়া প্রদানকারী গাছ (Shade providing plant) হিসেবে এবং প্রাকৃতিক বেড়া (Natural fence) তৈরিতে এই গাছের জুড়ি মেলা ভার।
কিন্তু শুধু চাষ করলেই চাষির আর্থিক লাভ হয় না, চাষে লাভের জন্য রোগ পোকার নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চলুন দেখে নেওয়া যাক এই ফুল চাষে কীভাবে রোগ পোকার আক্রমণ প্রতিহত করবেন ।
রোগ ও পোকার আক্রমণ (Insect infestation) -
বকফুল গাছে রোগ পোকার আক্রমণ খুব একটা দেখা যায় না, তথাপি ছত্রাকজনিত পাতায় ধুসর দাগ, ভাইরাসজনিত মোজাইক রোগ, কৃমিজনিত (Nematode) শিকড়ে গিঁট ইত্যাদি দেখা যায়। রোগ-পোকার উপদ্রব কমানোর জন্য গাছের আশেপাশের জায়গা পরিষ্কার রাখা জরুরি। সেক্ষেত্রে আগাছা দমনের জন্য প্রয়োজন মতো হাত-নিড়ানি দিতে হবে। প্রয়োজনে উপযুক্ত কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। কৃমিজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় নিমখোল বা ফিউরাডন দানা ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। ছত্রাক জনিত রোগের ক্ষেত্রে কার্বেন্ডাজিম বা ম্যানকোজেব ২.৫-৩ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে। মোজাইক রোগ প্রতিরোধে পতঙ্গ বাহক যেমন অ্যাফিড বা সাদামাছি দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড বা অ্যাসিটামিপ্রিড জাতীয় কৃষিবিষ ১ লিটার পরিমাণ ৩ লিটার জলে গুলে আঠা (Sticker) সহযোগে প্রয়োগ করতে হবে।
আরও পড়ুন - অতিরিক্ত লাভের উদ্দেশ্যে উন্নয়নযোগ্য ফসল বকফুল চাষ (Cultivation Of Sesbania Grandiflora)
বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও জলবায়ুর পরিবর্তন এই দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণ খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা (Food and Nutritional Security) অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। এখন আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো তার সাথে যুক্ত হয়েছে করোনা (Covid-19) মহামারী। অতি মাত্রায় বেড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের (সাইক্লোন, বন্যা, খরা) প্রাদুর্ভাব। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে চিরাচরিত ফসল চাষের পাশাপাশি বকফুল ও বকফুলের মতো পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, তথাকথিত অপ্রচলিত কিন্তু “সুযোগ্য উন্নয়নমূলক ফসল” চাষে আমাদের আরো জোর দেওয়া উচিত।
খুব সহজেই, বিশেষ কোন যত্ন ছাড়াই এগুলি জন্ম নেয়। রোগ পোকার আক্রমণও তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। আগামী দিনে এই ফসলগুলি নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বে, অদূর ভবিষ্যতে, ম্যাক্রো, মাইক্রো ও ফাইটো নিউট্রিয়েন্টস এ ভরপুর এই ফসলগুলি অপুষ্টি দূরীকরণে ও পুষ্টি সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে এই আশা রাখি।
Share your comments