আগাছা নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ আসলেই সবার আগে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণের চিন্তাভাবনা আমাদের মাথায় আসে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই জমিতে আগাছা দেখলেই ‘রাসায়নিক আগাছানাশক’ (Chemical weedicide/herbicide) প্রয়োগ করেই কৃষকবন্ধুরা এগুলি দমনের প্রচেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যাবত বাছবিচারহীন ও মাত্রাতিরিক্ত ‘কৃষিবিষ’ প্রয়োগের বহু কুফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাই আমাদের সকলেরই সুসংহত উপায়ে আগাছা নিয়ন্ত্রণের (Integrated management of weeds) উপর মনোনিবেশ করা উচিৎ।
ক) পরিচর্যা পদ্ধতিতে বদলের মাধ্যমে (Changes in cultural practices) –
১) যে সমস্ত সবজী খুব দ্রুত বৃদ্ধিদশা অতিক্রম করে (Fast growing crop), তারা সহজেই তাদের শাখা প্রশাখা বিস্তারের মাধ্যমে জমিতে আগাছার প্রকোপ কম করতে পারে।
যেমন- বরবটি, শিম, ভেন্ডি, ফরাস বিনস্ প্রভৃতি।
২) একই জমিতে একই গোত্রীয় ফসল বারবার চাষ না করে আলাদা আলাদা পরিবারভুক্ত ফসল চাষ করলে জমিতে আগাছার বাড়-বৃদ্ধি হ্রাস পায়। তাই শস্য আবর্তন (Crop rotation) খুবই জরুরী।
উদাহরনস্বরূপ – প্রতি বছর একই জমিতে টম্যাটো, লঙ্কা বেগুন জাতীয় সবজী চাষ না করে শিম্বী গোত্রীয় ফসল চাষ করা যেতে পারে।
৩) কিছু কিছু শাকজাতীয় স্বল্পমেয়াদী সবজীর বীজ যেমন, লাল শাক, পুঁই, পালং, কলমি, মেথি ঘন (Dense/ Closer seed sowing) করে বুনলে জমিতে আগাছার বিস্তার অনেকটা প্রতিরোধ করা যায়।
৪) কম সময় ব্যবধানে ও অগভীরভাবে জমি কর্ষণ করলে বা লাঙল দিলে বার্ষিক আগাছাগুলিকে অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
৫) জমিতে মূল ফসলের সাথে অন্তর্বর্তী/ সাথী ফসল (Intercrops) চাষ করলে অনেকাংশে আগাছা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যেমন, বেগুন, টম্যাটো, বাঁধাকপি যেগুলির সারি ও গাছ প্রতি ব্যবধান বেশী, সেখানে মুলো বা পালং জাতীয় সবজী অন্তর্বর্তী ফসল হিসাবে চাষ করা যাতে পারে।
৬) মটরের বীজ বপনের সময় কিছুটা বিলম্বিত করলে বথুয়া বা ক্যানারি ঘাস (Phalaris minor) ইত্যাদি আগাছার থেকে অনেকাংশে রেহাই মেলে।
৭) বীজ বপন বা প্রতিস্থাপনের পর থেকেই সবজী ফসলে সুষম পুষ্টি সরবরাহ সম্ভবপর হলে ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সময়মতো রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। স্বাস্থ্যবান চারাগাছ আগাছার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
৮) মূল জমিতে ফসল লাগানোর আগে মাটির সৌরকরণ (Soil solarization) করলে আগাছার বিস্তার অনেক কম করা সম্ভব হয়।
খ) যান্ত্রিক পদ্ধতিতে (Mechanical methods) –
আগাছা নিয়ন্ত্রণের সুপ্রাচীনতম ও অন্যতম একটি পদ্ধতি হল, হাত দিয়ে নিড়ানি দিয়ে বা খুরপি দিয়ে আগাছা তোলা। জমির পরিমাণ অল্প হলে খুব সহজেই এই পদ্ধতিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সাধারণত ফসলের উপর ভিত্তি করে সর্বনিম্ন ২ থেকে সর্বোচ্চ ৪ টি হাত নিড়ানি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া লাঙল, উইডার, কালটিভেটর ইত্যাদির মাধ্যমেও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জৈব ও অজৈব দু ধরণের উপাদান দিয়ে মালচিং করেও আগাছার প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। জৈব উপাদান যেমন খড়, কচুরিপানা, শুকনো পাতা, তুষ, ভুষি ইত্যাদি ও অজৈব উপাদানের মধ্যে প্লাস্টিক ফিল্ম ও বিভিন্ন রঙের পলিথিন দিয়েও মালচিং করা হয়ে থাকে।
গ) জৈবিক উপায়ে আগাছা দমন (Biological methods) –
এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি যেমন, ছত্রাক ও বিভিন্ন কীটশত্রু (Bioagent) ব্যবহার করে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ : কচুরিপানা নিয়ন্ত্রণের জন্য Cercospora rodmanii প্রজাতির ছত্রাক ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়া গেছে। উলু ঘাসের জন্য Orseoliella javanica ও পার্থেনিয়ামের জন্য মেক্সিকান বিটল (Zygogramma biocolorata) প্রজাতির কীট ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়া গেছে।
সবজী ফসলে আগাছানাশকের প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে- (Herbicides on crops) গুরুত্বপূর্ণ কিছু সবজী ফসলের আগাছানাশক স্প্রে করার সময়সূচী
ভারতবর্ষে জৈব কীটনাশক (Bio-pesticide) বা জৈব ছত্রাকনাশক (Bio-fungicide) জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও জৈব আগাছানাশক সেই অর্থে কৃষক বন্ধুদের কাছে প্রচলিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে জৈব আগাছানাশও জনপ্রিয়তা অর্জন করবে, সে আশা রাখাই যায়।
এবারে আসা যাক, রাসায়নিক আগাছনাশক ব্যবহার করে আগাছা নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গে। এটি অতি দ্রুত ও কার্যকরী একটি পদ্ধতি। নির্দিষ্ট ফসলে, সঠিক সময়ে এবং সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করলে এর দ্বারা অত্যন্ত লাভজনক ফলাফল পাওয়া সম্ভব। রাসায়নিক আগাছানাশকগুলিকে বিভিন্ন ভাবে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যেমন –
ক) নির্বাচনশীলতার উপর ভিত্তি করে (On the basis of selectivity) –
১) নির্বাচিত আগাছানাশক (Selective herbicide) – এগুলি কেবল মাত্র বিশেষ বিশেষ আগাছা মারতে সক্ষম (ঘাসজাতীয় অথবা চওড়া পাতা)।
যেমন – পেন্ডিমেথালিন, অ্যালাকলর, অক্সাডিয়াজোন, সিমাজাইন, মেট্রিবুজিন ইত্যাদি।
২) অনির্বাচিত আগাছানাশক (Non selective herbicide) – এরা প্রজাতি নির্বিশেষে জমির সমস্ত গাছকে মেরে ফেলে বা তাদের বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে।
যেমন – ডাইকুয়াট, প্যারাকুয়াট, গ্লাইফোসেট।
খ) কার্যপ্রণালীর উপর ভিত্তি করে (On the basis of mode of action) –
১) স্পর্শজনিত আগাছানাশক (Contact herbicide) – এগুলি আগাছার সংস্পর্শে এসে আগাছাগুলিকে মেরে ফেলে।
২) সর্বাঙ্গবাহী আগাছানাশক (Systemic herbicide) – এই আগাছানাশকগুলি প্রয়োগের পর আগাছার পাতা বা শিকড় দ্বারা শোষিত হয় ও সমগ্র প্ল্যান্ট সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে আগাছাগুলি মারা যায়।
যেমন – ২, ৪-ডি, সিমাজাইন।
গ) প্রয়োগের সময়ের উপর ভিত্তি করে (On the basis of time of application) –
১) ফসলের বীজ বোনার আগে বা মূল জমিতে চারা প্রতিস্থাপনের পূর্বে (Pre planting)
২) ফসলের বীজ বোনার পর কিন্তু আগাছা জন্মানোর আগে (Pre emergence)
যেমন – অ্যালাকলর, বিউটাক্লোর, সিমাজাইন।
৩) ফসল ক্ষেতে আগাছা জন্মানোর পর (Post emergence)
যেমন - ২, ৪-ডি, ডালাপন।
নিবন্ধ - শুভ্রজ্যোতি চ্যাটার্জ্জী (গবেষক, সবজী বিজ্ঞান বিভাগ, উদ্যান পালন অনুষদ, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মোহনপুর, নদীয়া )
Image source - Google
Related link - (Mini tractor only 30,000 rs.) মিনি ট্র্যাক্টর মাত্র ৩০০০০ টাকা, এই মিনি ট্র্যাক্টর ১ লিটার পেট্রোলেই চলবে এক বিঘা জমিতে
(Dragon fruit cultivation) সর্বরোগহারা ফল -ড্রাগন ফল, লাভজনক ড্রাগন ফল চাষের সম্পূর্ণ তথ্য
Share your comments