চা উৎপাদনে যেসব অন্তরায় রয়েছে তাদের মধ্যে চায়ের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় ও কৃমিপোকা অন্যতম। আবাদি এলাকায় চায়ের মশা, উঁইপোকা ও লালমাকড় এবং নার্সারি ও অপরিণত চা আবাদিতে এফিড, জেসিড, থ্রিপস, ফ্লাসওয়ার্ম ও কৃমিপোকা মুখ্য ক্ষতিকারক কীট হিসেবে পরিচিত। অনিষ্টকারী এসব পোকামাকড় বছরে গড়ে প্রায় ১৫% ক্ষতি করে থাকে।
চায়ের এসব ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও তাদের দমন ব্যবস্থা আলোচনা করা হলো।
চায়ের পোকামাকড় (Pest Management) :
১. চায়ের মশা : চায়ের মশা একটি গুরুত্বপূর্ণ কীট। এটি টি-হেলোপেলটিস নামে পরিচিত। চায়ের এ শোষক পোকাটির নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গ চায়ের কচি ডগা ও পাতার রস শোষণ করে এবং আক্রান্ত অংশ কালো হয়ে যায়। ব্যাপক আক্রমণে নতুন পাতা গজানো বন্ধ হয়ে যায়। চায়ের এ কীট দমনে শুষ্ক মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ২.২৫ লিটার হারে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ৫০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
২. লাল মাকড় :
চায়ের লাল মাকড় খুবই অনিষ্টকারী। আকারে অতি ক্ষুদ্র। পরিণত পাতার উপর ও নিচ থেকে আক্রমণ করে থাকে। রস শোষণের ফলে পাতার উভয় দিক তাম্রবর্ণ ধারণ করে এবং শুষ্ক ও বিবর্ণ দেখায়। এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে হেক্টরপ্রতি ২.২৫ কেজি হারে সালফার ৮০ ডবি্লউপি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৬ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
৩. উইপোকা :
উইপোকা মৌমাছির মতো সামাজিক পতঙ্গ। চা বাগানে ‘উলুপোকা’ নামে পরিচিত। এটা চায়ের অন্যতম মুখ্য ক্ষতিকারক কীট। চা গাছের মরা-পঁচা বা জীবন অংশ খায়। এরা মাটিতে ও গাছের গুঁড়িতে ঢিবি তৈরি করে বাস করে। কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণিই চা গাছ খেয়ে থাকে। পোকাদমনে হেক্টর প্রতি ১.৫ লিটার হারে এডমায়ার ২০০ এসএল ১০০০ অথবা ১০ লিটার হারে ডার্সবান ২০ ইসি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
৪. জেসিড :
নার্সারি ও অপরিণত চায়ের অন্যতম অনিষ্টকারী কীট। জেসিড দমনে হেক্টরপ্রতি ১.৫ লিটার হারে থাযোডান ৩৫ইসি অথবা ৫০০ মিলিলিটার হারে রিপকর্ড ১০ ইসি ৫০০ লি. পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। কচি ডগা ও কচি পাতার নিচে স্প্রে করতে হবে।
৫. এফিড : এদের জাবপোকাও বলা হয়। নার্সারি ও অপরিণত চায়ের অন্যতম অনিষ্টকারী কীট। হেক্টরপ্রতি ১.৫ লি. হারে থাযোডান ৩৫ ইসি অথবা ৫০০ মি.লি. হারে রিপকর্ড ১০ ইসি ৫০০ লি. পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
৬. থ্রিপস : থ্রিপস অতি ক্ষুদ্র বাদামি রংয়ের পোকা। নার্সারি ও অপরিণত চায়ের অন্যতম অনিষ্টকারী কীট। এই পোকা দমনে হেক্টরপ্রতি ১.৫ লিটার হারে থাযোডান ৩৫ ইসি অথবা ৫০০ মি.লি. হারে রিপকর্ড ১০ ইসি ৫০০ লি. পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর ২ বার স্প্র্রে করতে হবে।
৭. উরচুঙ্গা : নার্সারি ও অপরিণত চা আবাদিতে উরচুঙ্গা বড় সমস্যা। মুখে শক্ত ও ধারাল দাঁত আছে। সামনের পা জোড়া খাঁজকাটা, চ্যাপ্টা কোদালের মতো। পায়ের এ অবস্থার কারণে ছোট চা-চারাকে ধরে সহজেই কেটে ফেলে। এরা নিশাচর পতঙ্গ। মাটিতে গর্ত করে থাকে এবং সন্ধ্যার পর বের হয়ে আসে। এটা দমনে নার্সারি ও অপরিণত চা আবাদি এলাকার উরচুঙ্গার গর্তগুলো শনাক্ত করে গর্তের মুখে দুই চা চামচ পোড়া মবিল দিয়ে চিকন নলে পানি ঢেলে দিতে হবে। উরচুঙ্গা গর্ত থেকে বের হয়ে এলে লাঠি বা পায়ের আঘাতে মেরে ফেলতে হবে।
৮. কৃমিপোকা :
এরা মাটিতে বাস করে। অতিক্ষুদ্র ও আণুবীক্ষণিক পোকা। দেখতে সুতা বা সেমাই আকৃতির। কচি শিকড়ের রস শোষণ করে। ফলে গিট তৈরি হয়। আক্রমণে চারা দুর্বল ও রুগ্ন হয় এবং চারার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এ পোকা দমনে প্রতি ১ ঘনমিটার মাটিতে ফুরাডান ৫জি ১৬৫ গ্রাম হারে প্রয়োগ করলে ভালো।
অদ্যাবধি চায়ে ২২টি বিভিন্ন জীবাণুঘটিত রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। নিম্নে চায়ের প্রধান প্রধান রোগ ও তাদের দমন ব্যবসা আলোচনা করা হলো।
ক. নরম ডগা ও কচি পাতায় আক্রান্ত অংশ ফুলে গিয়ে ফোস্কার আকার ধারণ করে। এ রোগ দমনে চ্যাম্পিয়ন ৭৭ ডবি্লউপি ২.২৪ কেজি হারে বা ক্যালিঙিন ৮০ ইসি ১.১২ লিটার হারে হেক্টরপ্রতি ১১২০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে।
খ. নার্সারি ও আবাদি এলাকায় নরম ডগা ও কচি পাতায় আক্রান্ত অংশ কালো হয়ে ধীরে ধীরে উপর থেকে নিচের দিকে মরতে থাকে। এ রোগ দমনে চ্যাম্পিয়ন ৭৭ ডবি্লউপি ২.২৪ কেজি হারে বা কিউপ্রাভিট ৫০ ডবি্লউপি ২.৮ কেজি হারে বা ক্যালিঙিন ৮০ ইসি ১.১২ লিটার হারে হেক্টর প্রতি ১১২০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে।
গ. এক প্রজাতির শৈবালের আক্রমণে কাণ্ড ও বয়স্ক ডালে এ রোগের সৃষ্টি হয়। কাণ্ড আক্রান্ত হলেও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় পাতায়। পাতাগুলো হলুদবর্ণ ধারণ করে। এ রোগ দমনে ম্যাকুপ্রং ১৬ ডবি্লউ ২.২৪ কেজি হারে হেক্টর প্রতি ১১২০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত কাণ্ডে স্প্রে করতে হবে।
আরও পড়ুন - Red Spinach Farming - কম খরচে বাড়িতেই সুস্বাদু লাল শাকের চাষ কীভাবে করবেন, জেনে নিন বিস্তারিত
কুঁড়ি ও পাতা আহরণ -
এটি এমন এক ধরনের কাজ যেখানে কয়েকদিন পর পর চা গাছের কচি পাতা ও কুঁড়ি গাছের উপরের অংশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। রোপণের ৩ বছর পর থেকে পাতা আহরণ করা যায়। দুটি কচি পাতা ও একটি কুঁড়ি সাধারণত সংগ্রহ করা হয়। ছাঁটাইকরণ সময়ের প্লানিং নির্ভর করে সাধারণত বছরে ১৫/১৬ বার পাতা ও কুঁড়ি সংগ্রহ করা যায়।
৬০% চা, জুলাই, আগষ্ট ও সেপ্টেম্বও মাসে আহরন করা যায়।
২০% চা, জুন ও নভেম্বর মাসে আহরন করা হয়।
২০% চা, জুন, নভেম্বর মাস ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে আহরন করা হয়।
ফলন - চায়ের ফলন ১৭০০-৩৫০০ কেজি/হেক্টর হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন - Amaranth Farming Guidance – জেনে নিন মরসুম বিশেষে ডাটা শাকের বিভিন্ন জাত ও চাষের পদ্ধতি
Share your comments