
আলু উৎপাদনের সাথে সাথে আলু সংরক্ষণও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ আলু চাষের ক্ষেত্রে। আলু তোলার পর তা হিমঘরে দ্রুত সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ভারতে কেবলমাত্র উৎপাদিত আলুর ৪০ শতাংশ হিমঘরে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪৬১টি সরকার অনুমোদিত আলুর হিমঘর রয়েছে। এরমধ্যে হুগলী জেলায় ১৩৭টি এবং বর্ধমানে ১০৬টি রয়েছে। খাওয়ার আলু সংরক্ষণের জন্য ১০-১২ ডিগ্রি তাপমাত্রা প্রয়োজন। কিন্তু বীজ হিসেবে আলু সংরক্ষণ করতে হবে ২-৪ ডিগ্রিতে যাতে কল বেরোতে না পারে। এই তাপমাত্রায় আলু রাখলে কন্দে প্রচুর পরিমাপে শর্করা জমা হয় এবং মিষ্টি স্বাদের জন্য বাজারে চাহিদা কমে।
হিমঘরে আলু রাখার সময় কৃষক ও হিমঘরের পরিচালক কিছু নিয়ম মেনে চললে আলু দীর্ঘদিন সতেজ রাখা সম্ভব -
১) হিমঘরে প্রবেশের আগে প্রি-কুলিং চেম্বারে আলুর বস্তা ২৪ ঘন্টা রাখতে হবে।
২) ৮ বস্তা আলু পরপর একটির ওপর আর একটি রাখা যাবে। এর বেশী উচ্চতা হওয়া উচিত হবে না।
৩) আলু রাখার সময় বস্তা আছাড় দিয়ে ফেলা যাবে না।
৪) হিমঘর পরিষ্কার ও পরিশোধন করে আলু ঢোকানো উচিত।
৫) হিমঘরের তাপমাত্রা ২-৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৯০-৯৫ শতাংশ – এর মধ্যে রাখতে হবে এবং ওপরের বস্তার তাপমাত্রা থেকে নীচের বস্তার তাপমাত্রার পার্থক্য ০.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশী হবে না।
৬) হিমঘরের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রিতে নামানো যাবে না।
৭) বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা সঠিকভাবে করতে হবে যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা যায়।
হিমঘরে সংরক্ষণকালীন ক্ষতির সম্ভাবনাজনিত কারণের জন্য কৃষকভাইদের আলুর বীমা করানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ফেব্রুয়ারী-মার্চ – এ আলু তোলার পর দরিদ্র কৃষকরা সস্তায় আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন। মধ্যস্বত্বভোগীরা তা কিনে হিমঘরে বন্ডের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে মুনাফা করেন। কৃষক যাতে অভাবী বিক্রিতে বাধ্য না হন সেই লক্ষ্যে কিছু দেশীয় পদ্ধতিতে উৎপাদিত আলু সংরক্ষণের প্রযুক্তি প্রয়োগ করা যাতে পারে। এতে আলু জুলাই মাস পর্যন্ত সতেজ রাখা সম্ভব।
এ ব্যাপারে “জিরো এনার্জী কুল চেম্বার” – এ আলু সবচেয়ে বেশী দিন সংরক্ষণ করা যায়।
জিরো এনার্জী ‘কুল চেম্বার’ –
জিরো এনার্জী কুল চেম্বার ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান সংস্থায় পরিকল্পিত বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ার দ্বারা পরিচালিত ইট, বালি, বাঁশ, খড় বা বস্তা দ্বারা তৈরী শীতল কক্ষ। যার মধ্যে আলু দীর্ঘদিন সংরক্ষণ সম্ভব। প্রকোষ্ঠের ভিতরের তাপমাত্রা বাহিরের তাপমাত্রা থেকে প্রায় ১০-১৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড কম রাখা যায় এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৯০ শতাংশ – এর মত রাখা যায়।
প্রকোষ্ঠ বা শীতল ঘর তৈরীর পদ্ধতি –
১) ১৬৫ সেমি X ১১৫ সেমি উঁচু জায়গায় ইট দিয়ে ৬৭.৫ সেমি করে দুই সারি দেওয়াল গাঁথতে হবে। এই দুই দেওয়ালের মাঝে ৭.৫ ফাঁক থাকা চাই।
২) এভাবে তৈরী কক্ষটি পুরোপুরি তৈরী হলে এটাকে জল দিয়ে ভেজাতে হবে। এবার বালি দিয়ে দুই দেওয়ালের মাঝে ৭.৫ সেমি ফাঁকা জায়গাটি ভরাট করতে হবে। জল দিয়ে বালি ভেজাতে হবে।
৩) কক্ষের উপরের ঢাকনা/ছাদ বাঁশের কাঠামো করে তার উপর খড়, শুকনো ঘাস, বস্তা দিয়ে বাইরে তাপ নিরোধক করতে হবে। বৃষ্টির জল থেকে রক্ষার জন্য কক্ষটির উপর একটি চালাঘর তৈরী করা দরকার।
কার্য প্রণালী – কক্ষের তাপমাত্রা কমানো ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা বাড়ানোর জন্য রোজ দুবার জল দিয়ে ভেজাতে হবে। এরপর প্লাস্টিকের ঝুড়িতে করে আলু শীতল কক্ষে স্তরে স্তরে রেখে উপরে একটি পলিথিনের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
আলু সংরক্ষণের জন্যই রাজ্যে প্রায় ৪৫০টি হিমঘর রয়েছে। এরমধ্যে বর্ধমান ও হুগলী জেলায় সবচেয়ে বেশী। শেয়ার বাজারের মত হিমঘরে আলু রাখার জন্য বন্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে কৃষক ছাড়াও সাধারণ মানুষও প্রত্যক্ষভাবে আলুর কেনা-বেচার ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছেন। ফলে আলুকেন্দ্রিক বিপুল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হয় হিমঘর শিল্পে ও আলু ব্যবসায়। এছাড়া গ্রামেগঞ্জে বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তরকারী ব্যবসায়ীরা আলুর ব্যবসায় প্রত্যক্ষ জড়িত রয়েছেন। আর আলু উৎপাদনের উপকরণ যারা যোগান দেন যেমন সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী এবং আলুর বীজ সরবরাহকারীর সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু নানারকম প্রযুক্তিগত ত্রুটির জন্য হামেশাই আলুর উৎপাদন মার খায়।
কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিবছর সঠিক পরিমাণ আলুর উৎপাদনে সকলের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখা যাবে।
- অভিষেক চক্রবর্তী(abhishek@krishijagran.com)
Share your comments