আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যে সমস্ত মসলা ব্যবহার করি তার মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। পেঁয়াজকে শুধু মসলা বললে ভুল হবে। কারণ পেঁয়াজ একাধারে মসলা ও সবজিও বটে। যেকোনো তরকারি সঙ্গে ছাড়াও ভাতের সঙ্গে খালি পেঁয়াজ, ঝালমুড়িতে কাঁচা পেয়াজ, আলুভর্তায়, বেগুন ভর্তায়, এর ব্যবহার সবার কাছে সমাদৃত।
পেঁয়াজ এর পাতায় ভিটামিন ‘এ’ বেশি থাকে। তাছাড়া পেঁয়াজের পাতা ও ডাটায় ভিটামিন ‘সি’ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। পেঁয়াজ খাবার দ্রুত হজমকারক ও রুচিবর্ধক হিসেবেও এর জুড়ি নেই।
আসুন প্রথমে জেনে নেই, বীজ থেকে চারা উৎপাদন ও জন্যে কি কি করণীয় -
মাটি:
বেলে-দোআঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য ভালো, তবে পিএইচ মান ৫.৫ থেকে ৬.৫। এ ফসল চাষের জন্য বারবার চাষ দিয়ে মাটি বেশ ঝুরঝুরে করে নেয়া আবশ্যক। সুনিষ্কাশিত ও উত্তম জৈবপদার্থযুক্ত উর্বর মাটিতে পেঁয়াজ ভালো হয়।
পেঁয়াজের জাত বিন্যাস (Onion Species) -
তাহেরপুরী, বারি পেঁয়াজ-১ , বারি পেঁয়াজ-২ (রবি মৌসুম), বারি পেঁয়াজ-৩ (খরিপ মৌসুম) ।
বীজ বপন (Seed sowing) :
বীজতলায় বীজ বুনে চারা উৎপন্ন করে সে চারা জমিতে রোপণ করতে হয়। শল্ককন্দ রোপণ করা যায়। বীজ রোপণের জমিতে বীজ বপন করেও পেঁয়াজের চাষ করা হয়।
বীজ হার:
বীজ পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি ২.৫-৪ কেজি বীজ, কন্দ পদ্ধতিতে প্রায় ৫৫০ কেজি শল্ককন্দ।
চারা উৎপাদন:
৩ মিটার, ৯ মিটার আকারের বীজতলায় জন্য ২০-৩০ গ্রাম বীজের দরকার পড়ে। বীজ বপনের পর বীজগুলোর ৫-৬ সেন্টিমিটার পুরু বালু দিয়ে ঢেকে দিতে হয়।
বীজ বপনের সময়:
অক্টোবর-নভেম্বর মাস বীজতলায় বা জমিতে বীজ বপনের সময়। সরাসরি বীজ সারি করে বোনা উচিত।
রোপণের পদ্ধতি:
আমাদের দেশে তিনটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ করা হয়।
১. জমিতে সরাসরি বীজ ছিটিয়ে
২. বন্ধ বা বালব রোপণ করে
৩. বীজ থেকে তৈরি চারা সংগ্রহ করে রোপণ।
রোপণ দূরত্ব:
সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার। প্রতি সারিতে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব অন্তর ৫-৬টি চারা রাখা যায়। চারা রোপণের ক্ষেত্রে তা করা যায় বীজ বপনের প্রায় এক মাস পর। সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং সারিতে ৪ দূরত্ব ৮-১৬ সেন্টিমিটার রাখতে হবে। শল্ককন্দ রোপণ দ্বারা আগাম শস্য উৎপন্ন করা যায়। বিদেশি বড় জাতের পেঁয়াজের বীজ থেকে যে চারা হয় তা থেকে প্রথম বছর বীজ উৎপন্ন করা যায় না। সাধারণত ১-২ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট পেঁয়াজ ৩-৪০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে পেঁয়াজের জাত অনুসারে ৮-১৬ সেন্টিমিটার ব্যবধানে রোপণ করা যেতে পারে। পেঁয়াজের জমি চাষ দিয়ে মাটি ভেঙে দেয়া আগাছা দমন এবং পানি সেচের ব্যবস্থা করা উচিত।
সার প্রয়োগ:
গোবর, সার, খৈল ও টিএসপি সার জমি প্রস্তুতকালে এবং ইউরিয়া ও মিউরেট অব পটাশ সার চারা ১৫-১৮ সেন্টিমিটার উঁচু হওয়ার পর সারির ফাঁকে মালচিংয়ের আগে ছিটিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
পরিচর্যা:
গেঁড় লাগানো গাছে যে কলি বের হয় তা শুরুতে ভেঙে দিতে হয়। কলি তরকারি কিংবা সালাদরূপে ব্যবহৃত হতে পারে। বীজের উদ্দেশ্যে পেঁয়াজ ফসলের যে অংশ রাখা হয়, সেখানে ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগকালে হেক্টর প্রতি ১০ কেজি হিসেবে টিএসপি সার দ্বিতীয় দফায় প্রয়োগ করা যায়।
বীজ উৎপাদন:
বীজ তৈরি করার উদ্দেশ্যে বীজ অনেক ঘন করে বোনা যায়। ফলে একই জমি থেকে কয়েকগুণ বেশি সংখ্যায় ছোট আকারের পেঁয়াজ পাওয়া যায়। এগুলো সংরক্ষণ করে পরবর্তী বছরে ঘনভাবে রোপণ করলে সে শস্য থেকে বেশি পরিমাণে বীজ পাওয়া যায়।
বারি পেঁয়াজ-১ এর চাষের পদ্ধতি -
মাটি :
দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য ভাল।
আবহাওয়া : ১৫-২৫ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা পেঁয়াজের শল্ককন্দ উৎপাদনের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী।
বপন ও রোপণ পদ্ধতি এবং সময় :
পেঁয়াজ সরাসরি বীজ বুনে, শল্ককন্দ ও চারা রোপণ করে উৎপাদন করা হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজতলায় বপন করতে হবে।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ :
জমি গভীর চাষ ও মই দিয়ে আগাছা বেছে, মাটির ঢেলা ভেঙে সমতল করে তৈরি করতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি :
হেক্টরপ্রতি ২৫০-২৬০ কেজি ইউরিয়া, ১৮০-২০০ কেজি টিএসপি, ১৪০-১৬০ কেজি এমপি এবং ৭-১০ টন গোবর সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। শেষ চাষের সময় সবটুকু গোবর বা কম্পোস্ট, টিএসপি এবং ইউরিয়া ও এমপি সারের অর্ধেক পরিমাণ জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি চারা রোপণের ২৫ এবং ৫০ দিন পর দুই কিস্তিতে ক্ষেতে প্রয়োগ করতে হবে। শল্ককন্দ বা সরাসরি বীজ বপন করে চাষ করার ক্ষেত্রেও মোটামুটিভাবে এ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
পরিচর্যা : পেঁয়াজ সংগ্রহের দুই সপ্তাহ আগে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফসলের ফুলের কলি হওয়ামাত্রই তা ভেঙে দিতে হবে। পেঁয়াজ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সুতরাং পেঁয়াজের জমি থেকে পানি সরে যাবার সুবিধা থাকতে হবে।
পোকা দমন:
থ্রিপস পোকা পেঁয়াজের পাতার রস শোষণ করে। এগুলোকে ০.০৫ ভাগ শক্তির ডাইমেক্রন বা সেভিন ছিটিয়ে দমন করা যায়। টিইপিপি প্রয়োগেও উপকার পাওয়া যায়।
রোগ দমন:
গুদামে ও স্থানান্তর কালে ধূসর পচা রোগে পেঁয়াজের ঘাড়ের দিক পচে যায়। সেজন্য জমি থেকে সাবধানে পেঁয়াজ তুলতে হয় এবং গুদামজাত করার আগে পেঁয়াজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হয়।
ফলন:
দেশি পেঁয়াজের হেক্টরপ্রতি ফলন ৭-১৫ টন।
ফসল সংগ্রহ:
পেঁয়াজের গাছ নিজে নিজে শুকিয়ে যায়। তখন পেঁয়াজ ভালোভাবে পরিপক্ব হয় এবং ওঠানোর উপযোগী হয়।
সংরক্ষণ:
-
পেঁয়াজ ভালো করে শুকানোর পরে গুদামজাত করতে হয়। গুদাম ঠান্ডা ও বায়ু চলাচলের ব্যবস্থাযুক্ত হওয়া উচিত।
-
গুদামে পরীক্ষা করে পচা ও রোগাক্রান্ত পেঁয়াজ বেছে সরিয়ে ফেলতে হয়।
-
ঠান্ডা গুদামে ৩৪ ফা. তাপে এবং শতকরা ৬৪ ভাগ আর্দ্রতায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয়।
-
গেঁড় এর বেলায় এদের শেষের কয়েক সপ্তাহ ৭ ডিগ্রি হতে ১২.৭ ডিগ্রি সিলসিয়াস তাপে রাখা উত্তম।
আরও পড়ুন - জেনে নিন ধুন্দল চাষের পদ্ধতি (Cultivation Of Dhundal)
Share your comments