সর্বাধিক জনপ্রিয় পানীয় হলো চা | চা-এর চাহিদা যে আকাশছোঁয়া তা সবারই জানা | এই চা কিন্তু শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় বাংলাদেশেরও অর্থকরী ফসল | চা চাষ কৃষকবন্ধুদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক ফসল বটে | সমগ্র ভারতের মোট চা উৎপাদনের প্রায় ২৩ শতাংশ উৎপাদন করে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এ রাজ্যের প্রধানত তিনটি অঞ্চলের মোট ৩০৭ টি চা বাগিচা আছে। এই নিবন্ধে চা চাষের সম্পূর্ণ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো,
জলবায়ু(Climate):
উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশ যেখানে তাপমাত্রা ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বৃষ্টিপাত ২০০০ মিলিমিটারের উপরে ও বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি অর্থাৎ আর্দ্রতা ৭০-৯০% সেই এলাকা চা চাষের আদর্শ পরিবেশ। এছাড়া দিনের আলোর স্থায়িত্ব ১২ ঘণ্টার কাছাকাছি হতে হবে |
মাটি(Soil):
মাটি অম্লধর্মী (পিএইচ ৪.৫-৫.৮), বেলে দোআঁশ ও সন্তোষজনক পুষ্টিমানসম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। চা গাছ মোটেই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না, তাই জমি নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে |
বীজ বপন:
চা বীজ গুটিবাড়ি থেকে সংগ্রহ করে বীজতলায় ২০ সেন্টিমিটার থেকে ২০ সেন্টিমিটার ত্রিভুজ দূরত্ব পদ্ধতিতে লাগাতে হবে। বীজ বা কাটিং লাগানোর আগেই নার্সারির মাটি নেমাটোডমুক্ত রাখতে হবে। বীজতলায় ছায়া প্রদান আবশ্যক। প্রতি বেডে ৬০ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে বাঁশের চাটাই দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নার্সারির চারার বৃদ্ধি ও সজীবতার জন্য রাসায়নিক সার (ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি) ২:১:২ অনুপাতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। কাটিং নার্সারিতে ১৫০ থেকে ১৮০ সেন্টিমিটার উঁচুতে বাঁশের চাপ্টা দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নার্সারিতে নিয়মিত জল সেচ দিতে হবে।
আরও পড়ুন - Bamboo Farming: বাঁশ চাষে আপনিও হতে পারেন কোটিপতি, জেনে নিন সম্পূর্ণ পদ্ধতি
রোপণ পদ্ধতি(Plantation):
ক্লোন চারার জন্য ৩০-৩৫ সে.মি ও বীজ চারার জন্য ৪০-৪৫ সে.মি. গভীরতা বিশিষ্ট এবং উভয়টির জন্য ২৫-৩০ সে.মি. প্রশস্ততা বিশিষ্ট গর্ত করে ৪০-৫০ সে.মি. উচ্চতাসম্পন্ন সুস্থ সবল চারা রোপণ করতে হবে। গর্তেও প্রথম ২৩ সে.মি. মাটি গর্তের একপাশে তুলে রেখে সেই মাটির সাথে প্রতিটি গর্তের জন্য ২ কেজি পচা গোবর সার, ৩০ গ্রাম টিএসপি ও ১৫ গ্রাম এমপি মেশাতে হবে। সার মিশ্রিত এ মাটি গর্তের নিচে দিতে হবে। মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণের জন্য সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে রোপণের পর চারার গোড়া থেকে ৭ থেকে ১০ সেন্টিমিটার দূরে এবং ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার উঁচু করে মাল্চ বিছিয়ে দিতে হবে। মাল্চ হিসেবে কচুরিপানা, গুয়াতেমালা বা সাইট্রোনেলা ঘাস, এমনকি ঝোপ-জঙ্গলও ব্যবহার করা যেতে পারে। চা চারা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এনপিকে মিশ্রসার প্রতি গাছে প্রয়োগ করতে হবে।
ছায়া প্রদানকারী গাছ(Shelter tree):
প্রখর সূর্যতাপ এবং ঝড় বৃষ্টির হাত থেকে চা গাছকে রক্ষা করার জন্যে বাগানের ভেতরে কিছু স্থায়ী গাছ লাগাতে হয়। এ সমস্ত গাছগুলো ছায়াবৃক্ষ নামে পরিচিত। বৃক্ষগুলো শিম্বী পরিবারযুক্ত হলে এরা মাটিতে জৈব পদার্থ ও সরবরাহ করতে পারে। ১-১.৫ বছর বয়সের চারা চা বাগানে ছায়া বৃক্ষ হিসেবে ১৩ x ১৩ মিটার দূরত্বে লাগানো হয়
সার প্ৰয়োগ(Fertilizer):
চা গাছ চির সবুজ এবং পাতাই ফসল হিসাবে গন্য হয় বলে এ ফসলের জন্যে সার খুবই প্রয়োজনীয় |তবে ফসফরাস ও পটাশ সার ব্যবহার করা হয়। অল্পবয়সী চা গাছের জন্যে হেক্টর প্রতি ১৮ থেকে ৩৬ কেজি নাইট্রোজেন ব্যবহার করতে হয়। যেহেতু চা গাছ অম্লীয় মাটিতে ভাল জন্মায় | তাই ইউরিয়ার পরিবর্তে অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহার করা হয়। টি.এস.পি ও এম.পি সার যথাক্রমে ফসফরাস ও পটাশ সরবরাহ করে। গাছ ছাটাই করার পরে কুঁড়ি ধরাকালীন সময়ে ২২৫-৩০০ কেজি অ্যামোনিয়াম সালফেট প্রয়োগ করা হয়।
রোগবালাই ও দমন(Disease management system):
লাল মাকড়:
চায়ের লাল মাকড় খুবই অনিষ্টকারী। আকারে অতি ক্ষুদ্র। পরিণত পাতার উপর ও নিচ থেকে আক্রমণ করে থাকে। রস শোষণের ফলে পাতার উভয় দিক তাম্রবর্ণ ধারণ করে এবং শুষ্ক ও বিবর্ণ দেখায়। এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে হেক্টরপ্রতি ২.২৫ কেজি হারে সালফার ৮০ ডবি্লউপি ১০০০ লিটার জলে মিশিয়ে ৫-৬ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
কৃমিপোকা:
এরা মাটিতে বাস করে। অতিক্ষুদ্র ও আণুবীক্ষণিক পোকা। কচি শিকড়ের রস শোষণ করে। ফলে গিট তৈরি হয়। আক্রমণে চারা দুর্বল ও রুগ্ন হয় এবং চারার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এ পোকা দমনে প্রতি ১ ঘনমিটার মাটিতে ফুরাডান ৫জি ১৬৫ গ্রাম হারে প্রয়োগ করলে ভালো।
পরিচর্যা:
চা চাষে গাছ ছাঁটাইকরণ একটা গুরুত্বপূর্ন কাজ যা গাছকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় রাখা হয়, যা গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পাতা আহরণের জন্যে চা গাছকে একটা প্রয়োজনীয় উচ্চতা ও নতুন পাতা গজানোর জন্যে রোপণের সাড়ে ৩ বছর পর থেকে ছাঁটাই কাজ শুরু হয়। এর ফলে নতুন শাখাও বের হয়। প্রতি বছরই হালকা ছাঁটাই করা হয়। প্রথম ছাঁটাইকরণে গাছকে ৩০ সেঃমিঃ উপরে কাটা হয়। ৫/৬ বছর ধরে প্রতি ঋতুর শেষে ১০ সেঃমিঃ করে ছাঁটাই করা হয়। এভাবে ছাঁটাই করতে করতে চা গাছের উচ্চতা ১.২ মিটার হলে একজন শ্রমিক দাঁড়িয়ে পাতা সংগ্রহ করতে পারেন। তখন চা গাছকে বেশ নিচু থেকে ছাটাই করে পাতা তোলা উচ্চতায় নামানো হয়। ২৫/৩০ বছর পরে সমস্ত গাছকে মাটি থেকে তুলে পুনরায় চারা লাগানো হয়।
আরও পড়ুন - Vegetable Planting Calendar: ১২ মাসে কোন ফসল কোন সময়ে চাষ করবেন?
Share your comments