ভারত একটি কৃষি প্রধান দেশ হওয়ায় জনসংখ্যার বেশীরভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু ভারতীয় কৃষি এখন বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি। বর্তমানে ফসলের ফলন বাড়াতে কেবলমাত্র রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটি ও জলের গুণগত মান ক্রমশ: হ্রাস পাচ্ছে এবং পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, এমনকি চাষের জমিতে অতিরিক্ত পরিমান জল ব্যবহার করার ফলে মাটির ক্ষয় হচ্ছে এবং মাটির অম্লত্ব-ক্ষারত্বের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আবার উন্নয়নশীল শহর গুলিতে শিল্প গড়ে ওঠার কারণে কৃষি-কাজে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় জলের পরিমান দিনের পর দিন হ্রাস পাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ভূগর্ভস্থ জল স্তর প্রায় ০.৫ - ১ মিটার নিচে নেমে গেছে, আবার অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের জন্য দেশের বেশ কিছু জায়গাতে খরা দেখা দিয়েছে। সুতারাং অতিরিক্ত পরিমান জলের ব্যবহার এবং মাটির ক্ষয় রোধ করার জন্য আচ্ছাদন করা (Mulching) যেতে পারে।
আচ্ছাদন কী (Poly Mulch)?
বিভিন্ন প্রকার জৈব (খড়, ঘাস, গাছের পাতা, কাঠের গুঁড়ো, ফসলের খোসা ইত্যাদি) এবং অজৈব (প্লাস্টিক, পলিথিন,পাথর, বালি ইত্যাদি) পদার্থ দিয়ে চাষের জমির উপরিভাগকে ঢেকে দেওয়ার পদ্ধতিকে আচ্ছাদন বলা হয়।
আচ্ছাদন এর প্রকারভেদ -
সাধারণত আচ্ছাদন কে দুই ভাগে ভাগ করা যায় জীবন্ত (শিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদ যেমন বারসীম, লুসার্ন ইত্যাদি আচ্ছাদন হিসাবে লাগানো হয়) এবং নিষ্প্রাণ আচ্ছাদন। নিষ্প্রাণ আচ্ছাদন দুই প্রকার জৈব এবং অজৈব। জৈব আচ্ছাদন হচ্ছে অজৈব আচ্ছাদনের থাকে বেশি উপযোগী, কারণ জৈব আচ্ছাদন প্রাকৃতিক উপাদান থেকে পাওয়া যায়, যা সহজেই পচে মটিতে মিশে জৈব পদার্থ যোগ করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়; তবে বর্তমানে অজৈব আচ্ছাদন (প্লাস্টিক) খুব সহজ লভ্য এবং পুনব্যবহার যোগ্য হলেও এটি কিন্তু পরিবেশ বান্ধব নয়।
জৈব আচ্ছাদন:
১) খড়:
ধান বা গমের খড় একটি আদর্শ জৈব আচ্ছাদন উপাদান। এটি খুব সহজেই চাষ জমিতে ব্যবহার করা যায়, যা মাটির তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এমনকি জমির আগাছা নিয়ন্ত্রনেও সাহায্য করে। এছাড়াও খড় থেকে যে সূর্য রশ্মি প্রতিফলিত হয় তা থেকে কিছু কিছু গাছে ফল আসতেও সাহায্য করে। ৬-৮ ইঞ্চি পুরু করে বিছিয়ে এটি জমির উপরে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
২) কাঠের গুঁড়ো:
কাঠের আসবাব পত্র তৈরী করার সময় এই কাঠের গুঁড়ো পাওয়া যায়। এটিও একটি প্রচলিত জৈব আচ্ছাদনের উপকরণ। উচ্চ কার্বন এবং নাইট্রোজেন অনুপাত এর কারণে এটি মাটির সঙ্গে মিশে যেতে বেশি সময় নেয়। কাঠের গুঁড়ো জমিতে ব্যবহারের ফলে নাইট্রোজেনের ঘাটতি হতে পারে, তাই নিয়মিত সার প্রয়োগ প্রয়োজন। বেশি অম্ল যুক্ত মাটিতে এটি ব্যবহার করা যায় না, তবে কাঠের গুঁড়ো দীর্ঘ সময় জমিতে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
৩) গাছের ছাল:
এটিও খুব ভালো জৈব আচ্ছাদনের উপকরণ যা দীর্ঘ সময় মাটিতে আর্দ্রতা বজায় রাখতে এবং গাছর বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সারিবদ্ধ দুই সারি ফসল বা শাক-সব্জির জমির মাঝের ফাঁকা জায়গায় খুব সহজেই এটি ব্যবহার করা যায়।
৪) শুকনো পাতা:
শুকনো পাতা মাটির স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী যা মাটির সাথে মিশে গিয়ে মাটির গুনগত মানোন্নয়ন ঘটায়। এছাড়া শুকনো পাতা খুবই সহজলভ্য। ৩-৪ ইঞ্চি পুরু করে মাটির উপর ছড়িয়ে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
৫) ঘাস:
ছোট ছোট টুকরো করে কাটা শুকনো ঘাস একটি খুব ভালো জৈব আচ্ছাদন উপাদান। সারা বছরই এটি যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। যদি কাঁচা ঘাসের টুকরো জমিতে ব্যবহার করা যায়, তাহলে খুব সহজেই পচে মাটিতে মিশে যায় এবং মাটির মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমান বৃদ্ধি করে। কিন্তু বর্ষা কালে সবুজ ঘাসের টুকরো ব্যবহার করা যায় না, কারণ ভেজা মাটি ও বৃষ্টিপাতের জন্য এটি পুনরায় আগাছা হিসেবে গজিয়ে উঠতে পারে। তাছাড়াও যদি সবুজ কাঁচা ঘাস জমিতে ব্যবহার করা হয় তাহলে মাটির তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে যা গাছের জন্য ক্ষতিকারক। তাই সর্বদা শুকনো ঘাস’ই জৈব আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করা উচিত (প্রায় ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে)।
৬) কম্পোস্ট:
কম্পোস্ট খুব সহজেই তৈরি করা যায় বিভিন্ন প্রকার জৈব উচ্ছিষ্ট (পাতা, খাড়, ঘাস, সব্জীর খোসা, গোবর ইত্যাদি) দিয়ে তৈরি কম্পোস্ট সার জমিতে ব্যবহারের ফলে মাটির ভৌত-রাসায়নিক মানের উন্নয়ন ঘটে। কম্পোস্ট সার আচ্ছাদন ৩-৪ ইঞ্চি পুরু করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
৭) খবরের কাগজ:
জৈব আচ্ছাদন হিসাবে খবরের কাগজ ও ব্যবহার করা যেতে পারে। কাগজ সহজে মাটিতে মিশে যায় এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে; এছাড়াও সময় বাঁচে এবং কম পরিশ্রম করতে হয়।
জমিতে আচ্ছাদনের জন্য যদি জৈব উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা জমির স্বাস্থ্যও ভালো রাখে, জমিতে অনুকূল তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং আগাছা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে, ফলে ফলন বৃদ্ধি পায়।
Share your comments