মাছ চাষ (Fish Farming) একটি লাভজনক পেশা। মাছ চাষ করে অনেকেই তাদের দারিদ্রতা দূর করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ চাষের ক্ষেত্রে নিবিড় পদ্ধতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এক্ষেত্রে শিং মাছের নিবিড় চাষ পদ্ধতি অন্যতম।
আসুন জেনে নেই শিং মাছের নিবিড় চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।
শিং মাছের চাষ পদ্ধতি (Farming method) -
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতিঃ
শিং মাছের নিবিড় চাষের জন্য ২০-৫০ শতাংশ আয়তনের ছায়াযুক্ত পুকুর নির্বাচন করা যেতে পারে। শিং মাছ নিবিড় চাষের জন্য প্রথমত পুকুর ভালভাবে শুকাতে হবে। শুকানোর পর তলদেশের পচা কাদা অপসারণ করতে হবে এবং পাড় ভালভাবে মেরামত ও মজবুত করতে হবে। অতপর তলদেশ ছয় থেকে সাত দিন রৌদ্রে শুকাতে হবে। পরবর্তীতে তলা থেকে ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংস করার লক্ষ্যে প্রতি শতাংশে ২০-৩০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ভালভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগের ৩-৫ দিন পরে পুকুর বিশুদ্ধ জল দিয়ে ১.৫ মিটার পর্যন্ত পূর্ণ করতে হবে। জল পূর্ণ করার পর শতাংশ প্রতি ০.৫-১.০ কেজি কলিচুন জলে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরী করে পুকরে প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের ৩ দিন পরে পোনা মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোনা পরিবহনঃ
গুণগত মানসম্পন্ন সুস্থ-সবল পোনা সংগ্রহ এবং পরিবহন শিং মাছ চাষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাধারণত, শিং মাছের পোনা হ্যাচারি থেকে সংগ্রহ করা হয়। সে ক্ষেত্রে গুণগত মানসম্পন্ন সুস্থ-সবল বড় আকারের পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
শিং মাছের পোনা পরিবহনকালে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, সে কারণে পোনা পরিবহনের সময় প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করাই উত্তম। দূরত্ব অনুযায়ী প্রতি ড্রামে ৭-৯ সেমি আকারের ৩-৪ কেজি পোনা অথবা ১০০০-১৫০০ টি পোনা পরিবহন করা যায়। এরুপভাবে ৫-৬ ঘণ্টা সময় দূরত্বে নির্বিঘ্নে পোনা পরিবহণ করা যেতে পারে।
পোনা মজুদঃ
শিং মাছের নিবিড় চাষ ব্যবস্থাপনায় প্রতি শতাংশে ৩-৪ গ্রাম ওজনের ৩৫০০-৪০০০টি সুস্থ-সবল ও গুণগতমানসম্পন্ন স্ত্রী পোনা প্রস্তুতকৃত পুকুরে মজুদ করা যেতে পারে। পুকরে পোনা মজুদকালীন সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পোনা পুকুরে মজুদের সময় অবশ্যই পোনা ভর্তি পাত্রের পানির তাপমাত্রা ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা সমতায় এনে ভালভাবে অভ্যস্থকরণ বা কন্ডিশানিং করতে হবে। সাধারণত কম তাপমাত্রায় সকালে বা সন্ধ্যায় পোনা মজুদ করাই উত্তম।
সম্পূরক খাদ্যঃ
পোনা মজুদের পরের দিন থেকে প্রাণিজ প্রোটিন (৩২-৩৫%) সমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য মাছের দেহ ওজনের শতকরা ১২-৩% হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সম্পূরক খাদ্য দুই ভাগ করে সন্ধ্যায় ও সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়।। প্রতি ১০ দিন অন্তর মাছের নমুনায়ণ করে খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ ও সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
মজুদত্তোর ব্যবস্থাপনা -
প্রতি ১০ দিন অন্তর শিং মাছের নমুনায়ণ করে সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। পোনা মজুদের এক মাস পর হতে প্রতি ১৫ দিন অন্তর শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম চুন ও পরবর্তী ১৫ দিন পর ৪০০ গ্রাম লবন প্রয়োগ করতে হবে। সপ্তাহে কমপক্ষে ০৩ দিন বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করতে হবে। পুকুরের আয়তন অনুসারে এক বা একাধিক স্থানে কচুরি পানার বেষ্টনী স্থাপন করতে হবে। জলের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে গেলে অবশ্যই বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করতে হবে। ক্ষতিকর প্রাণির প্রবেশরোধে পুকুরের চারপাশে জাল দিয়ে বেষ্টনী দিতে হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা -
শিং মাছ চাষকালীন সময়ে রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়াবলী অনুসরণ করতে হবে-
শিং চাষে জৈব নিরাপত্তা ও রোগ প্রতিরোধ কৌশলঃ
পুকুরের অভ্যন্তরীণ জীবাণু ধ্বংস করা প্রয়োজন। জীবাণু ধ্বংস করার জন্য পুকুর শুকানো, চুন প্রয়োগ এবং পরিবেশবান্ধব জীবাণূনাশক ব্যবহার করতে হবে। পুকুরে বহিরাগত জীবাণু প্রবেশ রোধ করার লক্ষ্যে পুকুরের পাড় শক্ত ও মজবুত করার পাশাপাশি পুকুরের চারপাশে নেটের বেড়া দেওয়া, বহিরাগত প্রাণীর প্রবেশ রোধ, জালসহ বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহারের পূর্বে শুকানো এবং জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক।
শিং মাছের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ (Disease management) -
সাধারণত, শিং মাছ Aeromonas sp. I Pseudomonas sp. ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। নিম্নে রোগের লক্ষণ ও প্রতিকারের বিষয়ে আলোকপাত করা হলো-
রোগের লক্ষণসমূহঃ
-
আক্রান্ত মাছ খাদ্য গ্রহণে অনীহা প্রদর্শন করে।
-
মাছের শরীরে সাদা দাগ দেখা যায়।
-
মাছের লেজে পচন দেখা যায়।
-
সাদাটে দাগ ক্রমশঃ বিস্তৃত হয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীরে ঘা দেখা যায়।
-
মাছের শরীরে শ্লেষ্মার পরিমাণ কমে যায়।
-
মাছ ভারসাম্যহীনভাবে মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দিয়ে চলাফেরা করে।
প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণঃ
-
জল পরিবর্তন ও সঠিক ঘনত্বে শিং মাছ চাষ করতে হবে।
-
শতাংশ প্রতি ২০০ গ্রাম হারে চুন ও ৪০০ গ্রাম হারে লবণ প্রয়োগ করতে হবে।
-
শতাংশে প্রতি ৩ ফুট গভীরতার জন্য ৫-৭ গ্রাম হারে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ৩-৪ দিন প্রয়োগ করতে হবে।
-
প্রতি কেজি খাবারের সাথে ১-২ গ্রাম সিপ্রোফ্লোক্সাসিন মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে।
আরও পড়ুন - Dragon Fruit Farming – ড্রাগন ফল চাষে অভাবনীয় সাফল্য পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের বাসিন্দার
মাছ আহরণ ও উৎপাদনঃ
সাধারনত, পোনা মজুদের সাত মাস পর মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময়ে মাছের গড় ওজন ৫৫-৬৫ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। পুকুর শুকিয়ে শিং মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ পদ্ধতিতে অনুসরণে পঞ্চাশ শতাংশের পুকুর হতে ০৭ মাসে ৮.০-৯.০ টন শিং মাছ উৎপাদন করা যায়। শিং মাছের নিবিড় চাষে ৫০ শতাংশ পুকুরে ৩.৫-৪.০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে এক ফসলে ০৮-০৯ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
আরও পড়ুন - জানুন সঠিক 'হোস্ট গাছ 'নির্বাচনের মাধ্যমে চন্দন চাষের জন্য কি কি করণীয়
Share your comments