মানবজাতির কার্যকলাপের ফলে উৎপন্ন জৈব-দূষক পদার্থগুলি জলাশয়ের এই প্রাকৃতিক বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ত্বারাণ্বিত করতে পারে। এই ঘটনাটিকে কৃত্রিম বা মনুষ্য সৃষ্ট ইউট্রোফিকেশন বলে।
উৎসঃ
কৃষিক্ষেত্রঃ কৃষিক্ষেত্র থেকে চুইয়ে আসা জলের সাথে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি দ্রব্য ও জৈব পদার্থ জলাভুমিতে মিশে যায়।
গার্হস্থ বর্জ্য-পদার্থঃ এই ধরণের বর্জ্য পদার্থ প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি সম্পন্ন হয়, বিশেষত, নাইট্রোজেন ও ফসফরাস যা জলাশয়ে পুষ্টি দ্রব্য ও ক্ষতিকর শৈবালের প্রাচুর্য ঘটায়।
শিল্পজাত বর্জ্য পদার্থঃ ফসফেট শৈবালের প্রাচুর্যের জন্য দায়ী অন্যতম প্রধান একটি উপাদান। তাই ফসফেটযুক্ত ডিটা্রজেন্ট ও সার ব্যাবহারের ফলে জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে শৈবালের আধিক্য ঘটে ।
কারণঃ
নাইট্রেট ও ফসফেটযুক্ত সারের অতিরিক্ত ব্যবহারঃ কৃষিক্ষেত্র ও খামারের পরিচর্যার কাজে আমরা যে জৈবসারগুলি ব্যবহার করি, সেগুলি প্রধাণত নাইট্রেট ও ফসফেটযুক্ত হয়। ফলে এই জৈবসারগুলি কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহারের ফলে নাইট্রেট ও ফসফেটের সঞ্চয় বৃদ্ধি পেতে থাকে, যেখান থেকে বৃষ্টির জলের সাথে অথবা বায়ুপ্রবাহের প্রভাবে তা জলাশয়ের জলে গিয়ে মিশ্রিত হয় এবং জলের পুষ্টি- আধিক্য ঘটায়। এর ফলস্বরূপ জলের মধ্যে থাকা প্ল্যাঙ্কটন, শৈবাল ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদেরা এদের গ্রহণ বা শোষণ করে অতিরিক্ত পুষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে শৈবালের তীব্র ঘনত্ব তৈরি হয় এবং কচুরিপানায় জলাশয়ের উপরিভাগ আবৃত হয়।
পশু–খাদ্যবিতরণের ঘনীভূত পদ্ধতিঃ এই পদ্ধতিটি প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস উৎপাদনের জন্য দায়ী, যা পুষ্টি আধিক্য বা ইউট্রোফিকেশনের প্রধান কারণ। এই খাদ্য বিতরণ পদ্ধতি বহু পরিমাণে পুষ্টি দ্রব্য নির্গমন করে, যা জলজ পরিবেশে উচ্চ ঘনত্বে জমা হয়, এবং শৈবাল ও সায়ানোব্যাকটেরিয়ার আধিক্য ঘটায়।
জলাশয়ে গার্হস্থ বর্জ্য এবং শিল্প-জাত বর্জ্য সরাসরি নিক্ষেপ করাঃ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে গার্হস্থ বর্জ্যপদার্থ সরাসরি জলাশয়ে নিক্ষেপ করা হয়। ফলত, প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি দ্রব্য জলাশয়ে সঞ্চিত হতে থাকে এবং শৈবালের দ্রুত বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে, যা জলজ-জীবণকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।শিল্প-জাত বর্জ্যপদার্থগুলিকে জলাশয়ে সরাসরি নিক্ষেপ করার ফলেও একই পরিমাণ লক্ষ্য করা যায়। তাই এই ঘটনার প্রভাবকে হ্রাস করার জন্য উন্নত দেশগুলিতে বর্জ্যপদার্থগুলিকে প্রক্রিয়াকরণের পর ব্যবহার করার রীতি প্রচলিত আছে।
আকোয়ারিকালচারঃ আকোয়ারিকালচার এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে মাছ, চিংড়ি ও অন্যান্য জলজ গাছপালাকে (মাটির পরিবর্তে) জলজ পরিবেশে প্রতিপালন করা হয়, যেখানে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। এই পদ্ধতিটিকে যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা না যায়, তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য, মাছের রেচনপদার্থের সহিত মিশ্রিত হয়ে জলে নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
প্রাকৃতিক-ঘটনাসমূহঃ প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন প্রধাণত বন্যা, নদীস্রোত ভূমি থেকে অতিরিক্ত পুষ্টিকে প্রবাহিত করে, জলজ পরিবেশে বহূল পরিমাণে মিশিয়ে দেয়, যা জলাশয়ে শৈবালের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটায়। এছাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেও জলাশয়ের বার্ধক্যের কারণেও প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সঞ্চয় করে, যা ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও সায়ানব্যাকটে্রিয়ার ভয়ঙ্কর বৃদ্ধি ঘটায়।
জলজ পরিবেশে ইউট্রফিকেশনের ফলে, ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও অন্যান্য সালোকসংশ্লেষকারী গাছ অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পায়, যা “অ্যালগাল ব্লুম” নামে পরিচিত। শৈবালের এই অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির ফলে, জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়, যা জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এই সমস্ত জলজ শৈবাল ও আগাছাগর মৃত্যু ও পচন ঘটলে জলজ পরিবেশ অক্সিজেনশূন্য হয়ে পড়ে। জলজ পরিবেশে অক্সিজেনের ঘাটতি ঘটলে জলে থাকা প্রাণী ও উদ্ভিদেরা যেমন, মাছ, চিংড়ি ইত্যাদি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃতে পরিণত হয়। এই ঘাটতি বাড়তে বাড়তে যখন, অক্সিজেন শূণ্য অবস্থায় পৌঁছায় সেই চূড়ান্ত অবস্থায়, অবায়বীয় পরিবেশে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে, যা একপ্রকারের বিষাক্ত পদার্থ উৎপন্ন করে। এই বিষ স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখীদের প্রাণসংকটের জন্য দায়ী।
তথ্যসূত্র :
শতরূপা ঘোষ, অ্যাকোয়াটিক এনভারমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ।
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)