মাছের সঠিক পরিচর্যার জন্য যে জলে মাছ চাষ করা হয় বা রাখা হয়, সেই জলের গুণগতমান বজায় রাখা এবং জল পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ জল পরিষ্কার থাকলে তবেই সেই জলে থাকা মাছের স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। সাধারণত মাছের হ্যাচারীতে জলাধার-এর অপরিষ্কার নোংরা জল পরিষ্কার করার জন্য বিভিন্ন ধরণের ফিল্টার ও পাম্প ব্যবহার করা হয়। স্বল্প খরচে হ্যাচারীতে এবং অন্যান্য ট্যাঙ্কের জল পরিষ্কার ও পরিশোধন করার জন্য বিকল্প পদ্ধতি হিসাবে বায়োফিল্টার বা বায়োলজিক্যাল ফিল্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। দেখে নেওয়া যাক বায়োফিল্টার কী এবং তা কীভাবে কাজ করে -
বায়োফিল্টার - বায়োফিল্টার হল এক ধরণের যন্ত্র (Device), যেখানে হেটেরোট্রফিক ও অটোট্রফিক ব্যাক্টেরিয়া কালচারের মাধ্যমে অপরিষ্কার জলে থাকা জৈব নাইট্রোজেনযুক্ত (Nitrogenous) পদার্থকে মিনারেলাইজেশন (Mineralization), নাইট্রিফিকেশন (Nitrification), ডিনাইট্রিফিকেশন (Denitrification) –এর মাধ্যমে জল পরিশোধন করে তা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়।
বায়োফিল্ট্রেশন (Biofiltration) : বায়োফিল্টারের সাহায্যে দূষিত অপরিষ্কার জল পরিশোধন করার পদ্ধতিকে বায়োফিল্ট্রেশন বলে। এটি একটি জৈবিক পদ্ধতি।
১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম বায়োফিল্ট্রেশন পদ্ধতিতে ট্রিকলিং ফিল্টার (Trickling filter)-এর সাহায্যে দূষিত জল পরিশোধন করা হয়। এই পদ্ধতির সাহায্যে দূষিত অপরিষ্কার জল থেকে খুব সহজেই বায়োডিগ্রেডেবল (Biodegradable) পদার্থ দূরীভূত করা সম্ভব।
বায়োফিল্টারের গঠন : হ্যাচারীতে ব্যবহৃত ট্যাঙ্কের আকার, আয়তন ও ট্যাঙ্কে ব্যবহৃত জলের ঘনত্বের উপর বায়োফিল্টারের আয়তন নির্ভর করে।
সাইফনিং ইউনিট (Siphoning unit), সেটলিং ট্যাঙ্ক (Settling tank), ফার্স্ট ফিল্ট্রেশন চেম্বার (First filtration chamber), সেকেন্ড ফিল্ট্রেশন চেম্বার (Second filtration chamber) এবং এয়ারলিফট্ পাইপ (Airlift pipe) দিয়ে বায়োফিল্টার গঠিত হয়। এতে নুড়ি, পাথর, বালি, ঝিনুকের খোলা ইত্যাদি ফিল্টার মাধ্যম বা ফিল্টার বেড হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া বায়োফিল্টারে নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস যেমন- জল, মাটি ইত্যাদি থেকে নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া সংগ্রহ করে ফিল্টার মাধ্যম বা ফিল্টার বেড - এর পৃষ্ঠতলের inoculate বা কালচার করা হয়। বায়োফিল্টারে নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ফিল্টার মাধ্যম বা ফিল্টার বেড -এর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফলের উপর নির্ভর করে অর্থাৎ ফিল্টার মাধ্যমের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল যত বেশী হবে, তত বেশী পরিমাণ নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া ফিল্টার মাধ্যমের পৃষ্ঠতলে কালচার করা সম্ভব হবে।
বায়োফিল্টারের মাধ্যমে জল পরিশোধন প্রক্রিয়া : মাছের মল- মুত্রাদি এবং কানকোর মাধ্যমে নির্গত পদার্থ প্রভৃতি থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন জৈব ও অজৈব পদার্থ বিশেষত অ্যামোনিয়াকে দূর করার জন্য বায়োফিল্টারে দুই প্রকার নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয় –
১) Nitrosomonas sp - যা জলে উপস্থিত অ্যামোনিয়াকে জারিত করে নাইট্রাইট- এ রূপান্তরিত করে।
২) Nitrobactor sp - যা নাইট্রাইট কে জারিত করে নাইট্রেট-এ রূপান্তরিত করে।
বায়োফিল্টারের অপরিষ্কার জল পরিশোধন পদ্ধতি –
- প্রথমে ফিশ ট্যাঙ্কের জল পরিশোধন করার জন্য সাইফনিং ইউনিট – টি ফিশ ট্যাঙ্কের ভিতরে বসানো হয়। এরপর ফিশ ট্যাঙ্ক থেকে অপরিষ্কার জল সাইফনিং ইউনিট –এর মাধ্যমে একটি U – আকৃতির পাইপের সাহায্যে সেটলিং ট্যাঙ্ক – এর তলদেশে প্রবেশ করে।
- তারপর ফিল্টার মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সেটলিং ট্যাঙ্ক - এর তলদেশ থেকে জল ঊর্ধ্বমুখে বাহিত হয়ে একটি L – আকৃতির পাইপের সাহায্যে ফার্স্ট ফিল্ট্রেশন চেম্বার – এ প্রবেশ করে।
- এরপর ফার্স্ট ফিল্ট্রেশন চেম্বার – এ উপস্থিত ফিল্টার মাধ্যমের মধ্য দিয়ে জল ফার্স্ট ফিল্ট্রেশন চেম্বার – এর ফলস্ বটম –এ প্রবেশ করে। এই ফলস্ বটম হল বায়োফিল্টারের একটি বিশিষ্টতা। প্লাস্টিক বাটি দিয়ে তৈরি ফলস্ বটম টি ফিল্ট্রেশন চেম্বার – এর তলদেশে উল্টোভাবে (উপুর করে) বসানো হয়। অর্থাৎ বাটির খোলা অংশটি নীচের দিকে থাকে। এর ফলে বাটির ভিতরের খালি অংশে অর্থাৎ ফলস্ বটম –এ পরিশোধিত জল জমা হয়।

- এরপর ফার্স্ট ফিল্ট্রেশন চেম্বার – এর ফলস্ বটম থেকে পরিশোধিত জল এয়ারলিফট পাইপের সাহায্যে সেকেন্ড ফিল্ট্রেশন চেম্বার –এ প্রবেশ করে এবং ফিল্টার মাধ্যমের মধ্য দিয়ে জল সেকেন্ড ফিল্ট্রেশন চেম্বার –এর ফলস্ বটম –এ পৌঁছায়।
- তারপর সেকেন্ড ফিল্ট্রেশন চেম্বার –এর ফলস্ বটম থেকে পরিশোধিত জল এয়ারলিফট পাইপের মাধ্যমে বাহিত হয়ে আবার ফিশ ট্যাঙ্কে ফিরে যায়।
এইভাবে বায়োফিল্টারের সাহায্যে ফিশ ট্যাঙ্কের জল পরিশোধন করা হয়। এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ খরচ অনেকটাই কম হয় এবং জলের অপচয়ও রোধ করা যায়।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
তথ্যসূত্র - ড. প্রতাপ কুমার মুখোপাধ্যায়
Share your comments